মুনতাসীর মামুন
অধ্যাপক আহমদ বলছেন দেশের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক করার জন্য দেশী-বিদেশী পরামর্শকরা প্রতিনিয়ত সংলাপের কথা বলছেন। কিন্তু, তাঁর প্রশ্ন, ‘আওয়ামী লীগ কাদের সঙ্গে সংলাপে বসবে? সেই দলের সঙ্গে কী যারা রাষ্ট্রের মূল নীতিতেই বিশ্বাসী নয়? রাষ্ট্রের আদর্শিক অস্তিত্বকেই যারা মেনে নিতে চায়নি? সামরিক উর্দির অনুশাসনে গড়ে ওঠা দল বিএনপি তো পাকিস্তানী আদর্শে বিশ্বাস করে।... যারা দেশটাতে ইসলামাইজেশন করতে চেয়েছে তাদের সঙ্গে সমঝোতা কিসের?’ [২৪.৫.২০১২]
অধ্যাপক আহমদ যে একেবারে নতুন কথা বললেন তা নয়। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অনেকে এই কথা লিখেছেন বা বলেছেন। কিন্তু সুজন-সুশীলদের ঝড়ো প্রচারণায় তা চাপা পড়ে গেছে। অধ্যাপক আহমদের পর্যায়ে কেউ অবশ্য এমন পরিষ্কারভাবে বিএনপির উদ্দেশে এ কথা বলেননি। অভিননন্দন তাঁকে। নতুনভাবে আমাদের উচিত বিষয়টি পর্যালোচনা করা।
যুক্তরাষ্ট্রের যে ক’টি জায়গায় গেছি সেখানেই বাঙালীদের সঙ্গে দেখা হলে কুশলবিনিময়ের পরই প্রশ্ন দেশের অবস্থা কী? আমেরিকায় দীর্ঘদিন থেকেও তাঁদের প্রশ্ন আমেরিকা নিয়ে নয়, বাংলাদেশ নিয়ে। ইন্টারনেটে তাঁরা বাংলাদেশের পত্রিকা অধিকাংশই একবার না একবার দেখেন এবং হতাশ হন। প্রায় প্রতিদিন নতুন ইস্যু। আমি এসেছি এক সপ্তাহও হয়নি, কিন্তু শুনতে পেলাম পুলিশ নিয়ে কী একটা ঝামেলা হচ্ছে। আগেও হয়েছে, এখনও হবে, ভবিষ্যতেও এর থেকে নিস্তার নেই। কারণ, সব আমলেই মন্ত্রীরা হয়ে যান জনপ্রতিনিধি নয়, পুলিশ কর্মকর্তা। ফলে, অতিরিক্ত পুলিশী কর্মকা-ের কখনও বিচার হয় না। আর একটি দেশে যখন অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয় না তখন সে দেশে এ ধারা চলবেই।
যাক, কোন্ প্রসঙ্গ থেকে কোন্ প্রসঙ্গে চলে এলাম। প্রবাসীদের সঙ্গে যখন আলোচনা হয় তখনও আলোচনার ধারাটি এমনিই থাকে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বক্তব্যের মূল কথা বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাই সর্বৈব ক্ষমতা পেয়েছিলেন অনেক কিছু করার। কিন্তু তিনি কি তা পেরেছেন? সমস্যা থাকবেই কিন্তু তিনি কতটুকু তার সমাধান করতে পেরেছেন? সবশেষে, নির্বাচনের কী হবে? অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে কী হতো? আর দলের এ অবস্থা কেন? বিশেষ করে দলের সাধারণ সম্পাদক নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। বিএনপির মৃদু সমর্থকদের প্রশ্ন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে কী অসুবিধা হতো? শেখ হাসিনা নিজেই তো জোর-জবরদস্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনেছেন। আমি যেহেতু রাজনৈতিক ভাষ্যকার সেহেতু তাঁরা জানতে চাচ্ছেন।
সত্যি বলতে কী এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আমাদের জানা নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকা-ে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে এ রকম ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই।
এটি ঠিক, শেখ হাসিনা সব সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং মানুষের মন-মানসিকতা সমস্যা সমাধানের প্রধান অন্তরায়। কোন সরকারই সব প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে না। কিন্তু সদিচ্ছা থাকতে হবে। শেখ হাসিনার সে সদিচ্ছাটুকু আছে। প্রধান সমস্যা ছিল বিদ্যুত। কুইক রেন্টাল সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, পারেওনি। চারটি বছর গেল, কয়লানীতি হলো না। পুরনো বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও সেই ধরনের কেন্দ্র স্থাপন হলো না। সরকার এ বিষয়ে অনেক কথা বলতে পারে, তাদের তৌফিকের শেষ নেই কিন্তু শেষ কথা কাজগুলো সুচারুভাবে হয়নি। আবার অনেক কিছু হয়েছেও। সেগুলোর কথা কিছু নেতিবাচক ধারণার কারণে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে পারেনি। সেটির কারণ, তাঁর দলের স্থবিরতা। মন্ত্রিসভার অনেকের ব্যর্থতা। কিছু মন্ত্রী সামগ্রিকভাবে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করছেন। এর জন্য সরকারকে মাসুল দিতে হবে। এবং প্রধানমন্ত্রী যদি ভাবেন, মাসুল দেবেন তাতে আমাদের কী করার আছে? অধ্যাপক আহমদ জঞ্জাল পরিষ্কারের কথা বলছেন। ঠিকই আছে, কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলো তার মধ্যে পড়ে না। আর দলের সাংগঠনিক অবস্থা দলের নেত্রীই দেখবেন। তিনি যদি মনে করেন সব ঠিকঠাক আছে, তা হলে আমাদের বলার কী আছে? আমরা শুধু বলতে পারি, যে দলের নেতানেত্রীরা সমালোচনা-আলোচনা গ্রহণ করতে অক্ষম তাদের মধ্যে নেতা হওয়ার গুণের ঘাটতি আছে।
বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি বা অনেকে মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে জটিলতা। এক সময় খালেদা জিয়া এটি চাননি, এখন চাচ্ছেন। এক সময় হাসিনা চেয়েছেন, এখন চাচ্ছেন না। বিরোধী দলের ইস্যু দরকার ছিল, এটিই ইস্যু করা হয়েছে। যদি আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা না দেয়, তাহলেও বিএনপি তার অবস্থান থেকে নড়বে না। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সরকার নেই। তাতে কী, বিএনপির উত্তর হবে, পৃথিবীর কোন দেশে স্বাধীনতার পক্ষের ও স্বাধীনতার বিপক্ষের মানুষও তো নেই। এ দেশে আছে। যুক্তি যতই থাকুক বিএনপি কোন যুক্তিতেই রাজি হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হবে। যতক্ষণ বিএনপির মনে এ আস্থা জন্মাবে যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না ততক্ষণ তারা কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না। আগামী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের একাংশ সেই সুযোগ সৃষ্টি করলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় না এলে গত প্রায় চার দশক ধরে জিয়াউর-গোলাম আযমরা আদর্শের যে ভিত্তি স্থাপন করেছেন তা ধসে পড়বে। আবারও আদর্শগত রাজনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানপন্থীদের পরাজয় হবে। পরিস্থিতি এখন এ রকমই।
মূল বক্তব্য এই যে, দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার মূল কারণ, দু’ধরনের আদর্শ। অন্যান্য দেশে আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকে কিন্তু রাষ্ট্রের মূল বিষয়গুলো সবাই মেনে নেয়। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে তারা পরিণতি পেয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, ১৯৭১ সালে এই দ্বন্দ্বের নিরসন হয়েছে, জাতিরাষ্ট্র পরিণতি পেয়েছে। আসলে তা’ হয়নি। রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে বিপরীতধর্মী দু’টি আদর্শ এক রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। অনেকে যে এ বিষয়টিকে দু’নেত্রীর ঝগড়ার বিষয় হিসেবে দেখেন বা এই তত্ত্বই দিতে চান, তাঁরা হয় অতিচালাক, না হয় অতি মূর্খ। ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করেছি বটে তার তাৎক্ষণিক কারণ নির্বাচন কমিশন। বিএনপি আমলের নির্বাচন কমিশনাররা ছিল চাকর-বাকরের মতো। এখন এ কথা বলা যাবে না, বললেও গ্রহণীয় হবে না। প্রথম দু’টি সরকারের, সরকার প্রধানের কারণে, নির্বাচন উৎরে গেছে। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে ‘নিরপেক্ষ’ বলে কোন ব্যক্তি নেই।
অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ যথার্থ বলেছেন, ‘সমঝোতা হতে পারে সেসব দলের সঙ্গে যারা রাষ্ট্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী এবং সেই সমঝোতায় অবশ্যই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে অনেকেই এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেন। আমার প্রশ্ন হলো, নিরপেক্ষতা বিষয়টি কী? কেউ কি আসলে নিরপেক্ষ হতে পারেন। এ ধরনের সরকার পুরোপুরি অস্বাভাবিক। পৃথিবীর কোনও দেশে এটা দেখা যায় না। তাই এ ধরনের সরকার গঠনের মাধ্যমে এ দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানের চিন্তা করা গণতান্ত্রিক চেতনারই বিরোধী।’
এসব যৌক্তিক কথা আওয়ামী লীগ বিরোধী বা পাকিস্তানপন্থী কেউ মানবে না। সামনের নির্বাচন তাই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানপন্থীদের রাজনৈতিকভাবে দমিত করতে হলে আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগকে জিততে হবে। আর হারলে প্রগতিবাদীদের কণ্ঠ অনেকাংশে হারিয়ে যাবে। মূল লড়াইটা পাকিস্তানপন্থীরা আমাদের শাসন করবে না আমরা তাদের শাসন করব। ভুলে গেলে চলবে না এদেশের প্রায় অর্ধেক পাকিস্তানপন্থীদের সমর্থক। তাই লড়াইটা একটু কঠিনই বটে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্ন আড়ালে পড়ে যাবে যদি বর্তমান সরকার শেষ সময়ে হলেও মন্ত্রিসভায় কিছু অদলবদল করে শহরবাসীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ক্রয় ক্ষমতা কিছুটা হলেও যেন বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে গার্মেন্টস শিল্পকে তোষামোদ করা সরকারের বিপক্ষে যাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারে আরও প্রবল ভূমিকা গ্রহণ করা। ছাত্রলীগের দুর্র্বৃত্ত, পুলিশের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সিভিল সমাজকে খুশি করা। যদি তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সমঝোতা না হয় এবং ছাড় যদি দিতেও হয় তা হলেও এই আস্থা থাকতে হবে সমর্থকদের যে তারা জিতবেই। শুধু সেনা, পুলিশ, বেসামরিক আমলা তোয়াজ নির্বাচনে কোন ইতিবাচক ফল এনে দেবে না। সময় কম। এখনই এ বিষয়গুলো সুরাহার প্রশ্নে দল ও সরকারের নেতৃবৃন্দকে বসতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জিততে চায় কি না? না, তাদের সমর্থকদের পথে বসিয়ে দিতে চায় আগে যেমন দিয়েছে। শহরবাসীরা মনে করে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী নয় এবং টিভিতে শেখ হাসিনাকে যতই দেখান হোক না কেন দল ও সরকারের ওপর তাঁর তেমন নিয়ন্ত্রণ এখন আর নেই। গ্রামবাসীদের ধারণা, ততটা নেতিবাচক নয়। কিন্তু, আমরা মনে করি আদর্শগতভাবে পাকিস্তানপন্থীদের হটিয়ে গণতান্ত্রিক স্পেস সৃষ্টি করার সুযোগ শেখ হাসিনাকে করে দিয়েছিল সিভিল সমাজ। কিন্তু, সেই সিভিল সমাজ বা তার প্রতিনিধিদের মতামতের গুরুত্ব তিনি দেননি। পাকিস্তানপন্থীদের হটিয়ে দিতে যে সহায়তাটুকু সিভিল সমাজকে দেয়া উচিত ছিল তিনি বা তাঁর মন্ত্রীরা সে সহায়তা দেননি। [দু’একজন ব্যতিক্রমী আছেন]। তাঁরা ব্যস্ত থেকেছেন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের তোয়াজকরণে। এরা কখনই প্রগতিবাদীদের সহায়তা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে কিনা সন্দেহ। এখনও যদি সরকার ও দল সিভিল সমাজকে গুরুত্ব না দেয় ও কৌশল না বদলায় তাহলে তাদের বিপর্যয় রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।