মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

মূল প্রশ্ন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না অন্য কিছু?

মুনতাসীর মামুন

ঢাকা ছেড়ে চলে আসার আগে দৈনিক জনকণ্ঠে আমার শিক্ষক, জাতীয় অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের একটি সাক্ষাতকার পড়েছি। আমি অধ্যাপক আহমদের প্রথম পিএইচডি ছাত্র। তাঁকে দেখছি প্রায় চার দশক। তাঁর মতো মৃদুভাষী ভদ্রলোক এখনকার জমানায় বিরল। তিনি গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারেন এ কথা ভাবা যায় না। নব্বই বছর বয়সে অধ্যাপক আহমদ এখন ক্রুদ্ধভাবে সাক্ষাতকার দিয়েছেন সেটি একটি ঘটনা বটে। ত্যক্তবিরক্ত এবং সহ্যের সীমা অতিক্রম না করলে তিনি এমনভাবে কথা বলতে পারেন না। কী বলেছেন তিনি? 

অধ্যাপক আহমদ বলছেন দেশের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক করার জন্য দেশী-বিদেশী পরামর্শকরা প্রতিনিয়ত সংলাপের কথা বলছেন। কিন্তু, তাঁর প্রশ্ন, ‘আওয়ামী লীগ কাদের সঙ্গে সংলাপে বসবে? সেই দলের সঙ্গে কী যারা রাষ্ট্রের মূল নীতিতেই বিশ্বাসী নয়? রাষ্ট্রের আদর্শিক অস্তিত্বকেই যারা মেনে নিতে চায়নি? সামরিক উর্দির অনুশাসনে গড়ে ওঠা দল বিএনপি তো পাকিস্তানী আদর্শে বিশ্বাস করে।... যারা দেশটাতে ইসলামাইজেশন করতে চেয়েছে তাদের সঙ্গে সমঝোতা কিসের?’ [২৪.৫.২০১২]
অধ্যাপক আহমদ যে একেবারে নতুন কথা বললেন তা নয়। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অনেকে এই কথা লিখেছেন বা বলেছেন। কিন্তু সুজন-সুশীলদের ঝড়ো প্রচারণায় তা চাপা পড়ে গেছে। অধ্যাপক আহমদের পর্যায়ে কেউ অবশ্য এমন পরিষ্কারভাবে বিএনপির উদ্দেশে এ কথা বলেননি। অভিননন্দন তাঁকে। নতুনভাবে আমাদের উচিত বিষয়টি পর্যালোচনা করা।
যুক্তরাষ্ট্রের যে ক’টি জায়গায় গেছি সেখানেই বাঙালীদের সঙ্গে দেখা হলে কুশলবিনিময়ের পরই প্রশ্ন দেশের অবস্থা কী? আমেরিকায় দীর্ঘদিন থেকেও তাঁদের প্রশ্ন আমেরিকা নিয়ে নয়, বাংলাদেশ নিয়ে। ইন্টারনেটে তাঁরা বাংলাদেশের পত্রিকা অধিকাংশই একবার না একবার দেখেন এবং হতাশ হন। প্রায় প্রতিদিন নতুন ইস্যু। আমি এসেছি এক সপ্তাহও হয়নি, কিন্তু শুনতে পেলাম পুলিশ নিয়ে কী একটা ঝামেলা হচ্ছে। আগেও হয়েছে, এখনও হবে, ভবিষ্যতেও এর থেকে নিস্তার নেই। কারণ, সব আমলেই মন্ত্রীরা হয়ে যান জনপ্রতিনিধি নয়, পুলিশ কর্মকর্তা। ফলে, অতিরিক্ত পুলিশী কর্মকা-ের কখনও বিচার হয় না। আর একটি দেশে যখন অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয় না তখন সে দেশে এ ধারা চলবেই। 
যাক, কোন্ প্রসঙ্গ থেকে কোন্ প্রসঙ্গে চলে এলাম। প্রবাসীদের সঙ্গে যখন আলোচনা হয় তখনও আলোচনার ধারাটি এমনিই থাকে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বক্তব্যের মূল কথা বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাই সর্বৈব ক্ষমতা পেয়েছিলেন অনেক কিছু করার। কিন্তু তিনি কি তা পেরেছেন? সমস্যা থাকবেই কিন্তু তিনি কতটুকু তার সমাধান করতে পেরেছেন? সবশেষে, নির্বাচনের কী হবে? অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে কী হতো? আর দলের এ অবস্থা কেন? বিশেষ করে দলের সাধারণ সম্পাদক নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। বিএনপির মৃদু সমর্থকদের প্রশ্ন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে কী অসুবিধা হতো? শেখ হাসিনা নিজেই তো জোর-জবরদস্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনেছেন। আমি যেহেতু রাজনৈতিক ভাষ্যকার সেহেতু তাঁরা জানতে চাচ্ছেন।
সত্যি বলতে কী এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আমাদের জানা নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকা-ে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে এ রকম ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই।
এটি ঠিক, শেখ হাসিনা সব সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং মানুষের মন-মানসিকতা সমস্যা সমাধানের প্রধান অন্তরায়। কোন সরকারই সব প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে না। কিন্তু সদিচ্ছা থাকতে হবে। শেখ হাসিনার সে সদিচ্ছাটুকু আছে। প্রধান সমস্যা ছিল বিদ্যুত। কুইক রেন্টাল সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, পারেওনি। চারটি বছর গেল, কয়লানীতি হলো না। পুরনো বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও সেই ধরনের কেন্দ্র স্থাপন হলো না। সরকার এ বিষয়ে অনেক কথা বলতে পারে, তাদের তৌফিকের শেষ নেই কিন্তু শেষ কথা কাজগুলো সুচারুভাবে হয়নি। আবার অনেক কিছু হয়েছেও। সেগুলোর কথা কিছু নেতিবাচক ধারণার কারণে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে পারেনি। সেটির কারণ, তাঁর দলের স্থবিরতা। মন্ত্রিসভার অনেকের ব্যর্থতা। কিছু মন্ত্রী সামগ্রিকভাবে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করছেন। এর জন্য সরকারকে মাসুল দিতে হবে। এবং প্রধানমন্ত্রী যদি ভাবেন, মাসুল দেবেন তাতে আমাদের কী করার আছে? অধ্যাপক আহমদ জঞ্জাল পরিষ্কারের কথা বলছেন। ঠিকই আছে, কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলো তার মধ্যে পড়ে না। আর দলের সাংগঠনিক অবস্থা দলের নেত্রীই দেখবেন। তিনি যদি মনে করেন সব ঠিকঠাক আছে, তা হলে আমাদের বলার কী আছে? আমরা শুধু বলতে পারি, যে দলের নেতানেত্রীরা সমালোচনা-আলোচনা গ্রহণ করতে অক্ষম তাদের মধ্যে নেতা হওয়ার গুণের ঘাটতি আছে।
বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি বা অনেকে মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে জটিলতা। এক সময় খালেদা জিয়া এটি চাননি, এখন চাচ্ছেন। এক সময় হাসিনা চেয়েছেন, এখন চাচ্ছেন না। বিরোধী দলের ইস্যু দরকার ছিল, এটিই ইস্যু করা হয়েছে। যদি আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা না দেয়, তাহলেও বিএনপি তার অবস্থান থেকে নড়বে না। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সরকার নেই। তাতে কী, বিএনপির উত্তর হবে, পৃথিবীর কোন দেশে স্বাধীনতার পক্ষের ও স্বাধীনতার বিপক্ষের মানুষও তো নেই। এ দেশে আছে। যুক্তি যতই থাকুক বিএনপি কোন যুক্তিতেই রাজি হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হবে। যতক্ষণ বিএনপির মনে এ আস্থা জন্মাবে যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না ততক্ষণ তারা কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না। আগামী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের একাংশ সেই সুযোগ সৃষ্টি করলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় না এলে গত প্রায় চার দশক ধরে জিয়াউর-গোলাম আযমরা আদর্শের যে ভিত্তি স্থাপন করেছেন তা ধসে পড়বে। আবারও আদর্শগত রাজনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানপন্থীদের পরাজয় হবে। পরিস্থিতি এখন এ রকমই। 
মূল বক্তব্য এই যে, দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার মূল কারণ, দু’ধরনের আদর্শ। অন্যান্য দেশে আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকে কিন্তু রাষ্ট্রের মূল বিষয়গুলো সবাই মেনে নেয়। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে তারা পরিণতি পেয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, ১৯৭১ সালে এই দ্বন্দ্বের নিরসন হয়েছে, জাতিরাষ্ট্র পরিণতি পেয়েছে। আসলে তা’ হয়নি। রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে বিপরীতধর্মী দু’টি আদর্শ এক রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। অনেকে যে এ বিষয়টিকে দু’নেত্রীর ঝগড়ার বিষয় হিসেবে দেখেন বা এই তত্ত্বই দিতে চান, তাঁরা হয় অতিচালাক, না হয় অতি মূর্খ। ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করেছি বটে তার তাৎক্ষণিক কারণ নির্বাচন কমিশন। বিএনপি আমলের নির্বাচন কমিশনাররা ছিল চাকর-বাকরের মতো। এখন এ কথা বলা যাবে না, বললেও গ্রহণীয় হবে না। প্রথম দু’টি সরকারের, সরকার প্রধানের কারণে, নির্বাচন উৎরে গেছে। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে ‘নিরপেক্ষ’ বলে কোন ব্যক্তি নেই। 
অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ যথার্থ বলেছেন, ‘সমঝোতা হতে পারে সেসব দলের সঙ্গে যারা রাষ্ট্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী এবং সেই সমঝোতায় অবশ্যই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে অনেকেই এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেন। আমার প্রশ্ন হলো, নিরপেক্ষতা বিষয়টি কী? কেউ কি আসলে নিরপেক্ষ হতে পারেন। এ ধরনের সরকার পুরোপুরি অস্বাভাবিক। পৃথিবীর কোনও দেশে এটা দেখা যায় না। তাই এ ধরনের সরকার গঠনের মাধ্যমে এ দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানের চিন্তা করা গণতান্ত্রিক চেতনারই বিরোধী।’
এসব যৌক্তিক কথা আওয়ামী লীগ বিরোধী বা পাকিস্তানপন্থী কেউ মানবে না। সামনের নির্বাচন তাই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানপন্থীদের রাজনৈতিকভাবে দমিত করতে হলে আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগকে জিততে হবে। আর হারলে প্রগতিবাদীদের কণ্ঠ অনেকাংশে হারিয়ে যাবে। মূল লড়াইটা পাকিস্তানপন্থীরা আমাদের শাসন করবে না আমরা তাদের শাসন করব। ভুলে গেলে চলবে না এদেশের প্রায় অর্ধেক পাকিস্তানপন্থীদের সমর্থক। তাই লড়াইটা একটু কঠিনই বটে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্ন আড়ালে পড়ে যাবে যদি বর্তমান সরকার শেষ সময়ে হলেও মন্ত্রিসভায় কিছু অদলবদল করে শহরবাসীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ক্রয় ক্ষমতা কিছুটা হলেও যেন বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে গার্মেন্টস শিল্পকে তোষামোদ করা সরকারের বিপক্ষে যাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারে আরও প্রবল ভূমিকা গ্রহণ করা। ছাত্রলীগের দুর্র্বৃত্ত, পুলিশের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সিভিল সমাজকে খুশি করা। যদি তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সমঝোতা না হয় এবং ছাড় যদি দিতেও হয় তা হলেও এই আস্থা থাকতে হবে সমর্থকদের যে তারা জিতবেই। শুধু সেনা, পুলিশ, বেসামরিক আমলা তোয়াজ নির্বাচনে কোন ইতিবাচক ফল এনে দেবে না। সময় কম। এখনই এ বিষয়গুলো সুরাহার প্রশ্নে দল ও সরকারের নেতৃবৃন্দকে বসতে হবে। 
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জিততে চায় কি না? না, তাদের সমর্থকদের পথে বসিয়ে দিতে চায় আগে যেমন দিয়েছে। শহরবাসীরা মনে করে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী নয় এবং টিভিতে শেখ হাসিনাকে যতই দেখান হোক না কেন দল ও সরকারের ওপর তাঁর তেমন নিয়ন্ত্রণ এখন আর নেই। গ্রামবাসীদের ধারণা, ততটা নেতিবাচক নয়। কিন্তু, আমরা মনে করি আদর্শগতভাবে পাকিস্তানপন্থীদের হটিয়ে গণতান্ত্রিক স্পেস সৃষ্টি করার সুযোগ শেখ হাসিনাকে করে দিয়েছিল সিভিল সমাজ। কিন্তু, সেই সিভিল সমাজ বা তার প্রতিনিধিদের মতামতের গুরুত্ব তিনি দেননি। পাকিস্তানপন্থীদের হটিয়ে দিতে যে সহায়তাটুকু সিভিল সমাজকে দেয়া উচিত ছিল তিনি বা তাঁর মন্ত্রীরা সে সহায়তা দেননি। [দু’একজন ব্যতিক্রমী আছেন]। তাঁরা ব্যস্ত থেকেছেন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের তোয়াজকরণে। এরা কখনই প্রগতিবাদীদের সহায়তা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে কিনা সন্দেহ। এখনও যদি সরকার ও দল সিভিল সমাজকে গুরুত্ব না দেয় ও কৌশল না বদলায় তাহলে তাদের বিপর্যয় রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

হিলারির বাংলাদেশ দর্শন ও অর্থমন্ত্রীর হিলারি দর্শন


                                        মুনতাসীর মামুন

‘রাবিশ’- এই একটি শব্দ অনেক বাঙালীর হাসিমুখ মলিন করে দিয়েছে। সবাই ভাবছিলেন, বাংলাদেশ আমেরিকার ৫১তম রাজ্য হতে না পারুক, জানি দোস্ত তো হয়ে গেল। এখন আর বাংলাদেশকে পায় কে! ব্যবসায়ীরা টাকার স্রোতে ভেসে যাবেন, যে কোন বিমানবন্দরে গিয়ে দাঁড়ালেই বাঙালীকে সাদর অভ্যর্থনা জানান হবে, হয়ত ভিসাও আর লাগবে না। আপনি ভাবছেন, অতিশয়োক্তি করছি। বিন্দুমাত্র না। আজ যদি আমেরিকা বলে দ্বার খুলে দিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে যারা আসবে তারা আমেরিকান সিটিজেন। প্রায় ১৬ কোটি বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দেবে। ইসলামী হুকুমত কায়েম যাঁরা করতে চান খুন, ধর্ষণ ও লুটের মাধ্যমে সেই গোলমাল আযম ও মতি নিজামীর পুত্ররাও ঐ নাছারার দেশে বসবাস করেন, সৌদি আরবে নয়। রাজনীতিবিদ, গার্মেন্টস মালিক, আমলাদের পুত্র কন্যারা তো অনেক আগেই সেখানে। হয়ত লেফটিদেরও।
কিন্তু ঐ ‘রাবিশ!’ একটি শব্দই বোধহয় সব শেষ করে দিল। আমাদের প্রিয় অর্থমন্ত্রীর প্রিয় শব্দ ‘রাবিশ’। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য শুনলে বোঝা যায় ঝানু রাজনীতিবিদ ও কম রাজনীতিবিদের পার্থক্য। ঝানুরা এমন সব বক্তব্য রাখেন যার কোন অর্থ হয় না। ম্যাডাম হিলারি অপ্রাসঙ্গিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ওয়াশিংটন থেকে তিনি বিষয়টি মনিটর করবেন। এই উক্তি ড. ইউনূস, তাঁর ভক্তদের [গ্রামীণ ব্যাংকের নয়] উল্লসিত করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু, কারও কি মনে হচ্ছে না, এ ধরনের উক্তি ঐ পর্যায়ে করা যায় না। ড. ইউনূসও করেননি। এবং এ ধরনের উক্তি একটি দেশ বা জাতিকেও অপমান করে। অনেকে এও বলতে কসুর করবেন না যে ড. ইউনূস ইচ্ছাকৃতভাবে দেশটির সরকার ও মানুষকে ধমক দেয়াচ্ছেন। এটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে, আমাদের লেফটি ব্রাদাররাও এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি, যদিও তাঁরা হিলারির আগমন উপলক্ষে কয়েকজনের মিছিল, বিবৃতি দিয়েছিলেন। মনে মনে হয়ত লেফটিরাও চান, আমেরিকা দোস্ত হলে তাদের পরিবার পরিজন ও সন্তানদের নিউইয়র্ক চলে যাওয়া সহজ হবে। এক কথায়, সুধীজনদের ধারণা, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছিল, আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি মন্তব্য তা ধূলিসাত করে দিয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব মুহিত বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে হিলারির বিবৃতির কোন যুক্তি নেই। উনি বলেছেন ওনার কথা। গ্রামীণ ব্যাংক সরকার দখল করবেÑ এমন অভিযোগ রাবিশ। আমি দুঃখিত যে রাবিশ শব্দটি ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমাকে রাবিশই বলতে হচ্ছে।’ [প্র. আলো, ৯.৫.২০১২]
আমার কাছে মনে হয়েছে, হিলারি যা বলছেন তা অনাকাক্সিক্ষত। এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ও কূটনৈতিক দৃষ্টিতে অনাকাক্সিক্ষত মনে হলেও তার মধ্যে অপমানের একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা আছে। সেটি প্রশংসনীয়। কিন্তু, এটা কি ঠিক নয়, ম্যাডাম হিলারির আগমন এই সরকারকে উল্লসিত করেছে? এটিকে তারা তাদের নীতির বিজয় বলে মনে করছে। এবং সবাই জানে, আমেরিকা এভাবেই কথা বলবে এবং তা শুনে যেতে হবে। যদি শুনতে না চান তা’হলে হিলারিকে নিয়ে এত মাতামাতির দরকার ছিল না। এত কাঠখড় পোড়ানোর দরকারও ছিল না। তারা কি জানতেন না এ প্রসঙ্গ আসবেই। হিলারির চেয়ে পদমর্যাদায় ওপরে এবং যে দেশটি ও দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি করেছে বাংলাদেশের জন্য এবং এখনও যে দেশই সবচেয়ে বড় দাতা সেই জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তো সরকার, মিডিয়া, সুজনরা এত আলোড়িত হয়নি। আমার মনে হয় বরং অর্থমন্ত্রী যদি বলতেন, ব্যাংক অব আমেরিকা ঠিকমতো চলছে না। এ নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংক অব আমেরিকার কার্যকলাপ মনিটরিং করব তা’হলে রাবিশের মতো কঠিন শব্দ ব্যবহার করতে হতো না। হিলারিরাও বুঝতেন যে তাঁদের বক্তব্য যা তারা মনে করছেন যথার্থ আসলে কত এ্যাবসার্ড। বাংলাদেশ হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুকে এ ধরনের অনেক কথা শুনতে হয়েছে এবং তিনি হাসিমুখে এমন সব মোক্ষম জবাব দিয়েছেন যে দ্বিতীয়বার সেসব প্রসঙ্গ আর রাজা বাদশাহ প্রেসিডেন্টরাও তোলেননি। আমাদের ন্যাতারা যত বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করেন তত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পড়েন কিনা সন্দেহ। একটি উদাহরণ দিই।
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াকুব গাওয়ান বললেন বঙ্গবন্ধুকে, ‘অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙ্গে দিতে গেলেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনার কথাই হয়ত ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়ত শক্তিশালী ছিল। তার চেয়েও শক্তিশালী হয়ত অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া, আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এই বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়।’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্মারকগ্রন্থ/১ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ]
যা হোক অর্থমন্ত্রী ঐ ধরনের মন্তব্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে করতেই পারতেন। মতিয়া চৌধুরী মাইকের সামনে থাকলে, বিরোধীদের প্রসঙ্গ উঠলে যে প্রবলভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে যান তিনিও কিন্তু কবির আবৃত্তি করার ভঙ্গিতে বলেছেন, মার্কিন উচ্চ আদালত একটি রায় দিলে কি হিলারি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন? আমরা অন্য একটি দেশ, আমাদের আদালত একটি রায় দিয়েছে। সেটি নিয়ে অন্য দেশের মন্ত্রী কিভাবে প্রশ্ন তোলেন? কারণটা একই। গরিবের সুন্দরী স্ত্রী দেখলে সবাই ভাবি বলে চান্স নিতে চায়। বাংলাদেশ এখন গরিবের সুন্দরী স্ত্রীÑ এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। আমেরিকার প্রিয় তো আমরাই হতে চাই। আমেরিকা কি চেয়েছে? ১৯৭১ সালে চায়নি। কিন্তু আমরা হচ্ছি নাছোড়বান্দা প্রেমিকা। বরং আমাদের আইনমন্ত্রী যদি বলতেন, বুশ-গোর নির্বাচনে মার্কিন সুপ্রীমকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা পক্ষপাতমূলক। বাংলাদেশ তা মানে না। সুপ্রীমকোর্টের এই কার্যাবলী বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করবে।
আমাদের একটি পথ বেছে নিতে হবে। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক প্রতিদিনই তো চড়চাপড় দিচ্ছে বাংলাদেশকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা দ্বিমত প্রকাশ করলেও তো অর্থমন্ত্রী বলছেন, বার বার, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না।’ এই মনোভঙ্গি এবং হিলারিকে ধমকানো দুটি পরস্পর বিরোধী। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যে এত টানাপোড়েন তার একটি প্রধান কারণ অর্থ মন্ত্রণালয়। যদি তারা গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণ না চান তাহলে দ্রুত সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল এবং আইন বা কাঠামো বদলে যাঁরা চালাতে পারবেন তাঁদের দেয়া উচিত ছিল। যে ৫৪টি কোম্পানির কথা অর্থমন্ত্রী তুলছেন তার নিষ্পত্তি এতদিন কেন করেননি অর্থমন্ত্রী? সেই প্রশ্ন কিন্তু আমাদের থেকে নয়, তাঁর দল ও নীতি নির্ধারকদের থেকেও উঠছে যার খোঁজ তিনি জানেন না। অর্থ মন্ত্রণালয় পুরো বিষয়টি লেজেগোবরে করে ফেলেছে, যা পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও অভিঘাত সৃষ্টি করছে। ড. ইউনূস আর যাই হোন বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তাদের মতো অদক্ষ নন।
অর্থমন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন। শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য তিনি সেই সব চামচাদের বিশ্বাস করেন যারা তাকে ছোট করে। ড. ইউনূসের সৌভাগ্য, তাঁর চামচারা তাঁকে ক্রমেই বড় থেকে বড় করে তোলেন।
হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসতে চাননি। কিন্তু, আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই বাধ্যতা সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও শেখ হাসিনা। সে বিষয়ে পরে আসছি। হিলারি পৃথিবী নিয়ন্ত্রণকারী দেশটির রাজনীতির একজন তারকা দুই যুগ ধরে। ওবামা থেকে বেশি লোক তাঁকে চেনে। কোকাকোলার মতো একটি ব্র্রান্ড নেম। ড. ইউনূস ঐ পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধু। ক্লিনটন ইনিসিয়েটিভে বাংলাদেশ ডলার অনুদান দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক বা ফাউন্ডেশনও দিয়েছে বলে শুনেছি। যদিও টাকার অঙ্কটা জানা যায়নি, বন্ধুত্ব ও অনুদান দু’টি মিলে বাংলাদেশ থেকে ড. ইউনূস বেশি গ্রহণযোগ্য ক্লিনটন পরিবারে। সেই ইউনূসের অপসারণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে অপমান হিসেবে নিয়েছেন হিলারি। আমাদের ভুললে চলবে না হিলারি একজন মহিলা। আমাদের মহিলাদেরও তো দেখেছি। ব্যক্তিগত জেদ বা আবেগ অনেক সময় রাষ্ট্রীয় নীতিকেও পরিচালিত করে। জনাব মুহিত ঠিক বলছেন, গ্রামীণ ব্যাংক গঠনে, পৃষ্ঠপোষকতায় তো আমেরিকা একটি সেন্ট দেয়নি। তাহলে এ বিষয়ে তাদের বলার অধিকারও তো নেই। কিন্তু হিলারির জেদের রাডারে সেটি ধরা পড়ছে না। তবে, মার্কিন প্রশাসন হিলারির সঙ্গে একমত এটি ভাবার কোন কারণ নেই। রাজনৈতিক কারণে বা আসন্ন নির্বাচনের কারণে তারা হিলারির জেদ মেনে নিচ্ছে। হিলারি না থাকলে এ বিষয়ে তারা আদৌ মাথা ঘামাবে কিনা সন্দেহ। মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট প্রয়োজনে এদের সবাইকে ঝেড়ে ফেলবে। তারা ব্যক্তিস্বার্থ ও দেশের স্বার্থ আলাদা হিসেবে বিবেচনা করে। হিলারি দেশ ও ব্যক্তিস্বার্থ এক করে ফেলেছেন।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেভাবেই হোক হিলারি ম্যাডামকে একবার নিয়ে আসা ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরের বন্দোবস্ত করা। সেটি হয়নি।
ড. ইউনূস ইস্যু সৃষ্টি হওয়ায় হিলারি ঢাকা আসা দূরের কথা বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য মাধ্যমে যতটা পারা যায় বাংলাদেশকে শিক্ষা দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। এবং পরিষ্কার ভাষায় বলছেন, বাংলাদেশ কিছু চাইলে ড. ইউনূসকে নিতে হবে। বাংলাদেশ রাজি হয়নি, হিলারিও পাত্তা দেননি। বাংলাদেশ এখনও সেই বিনিময়ে রাজি নয়, কিন্তু হিলারি কেন আসতে বাধ্য হলেন?
ভারত-মার্কিন স্বার্থ এখন অভিন্ন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে একটি কাজ করেছেন যা বাংলাদেশের কেউ করেনি। করার সাহসও পায়নি। তাহলো উগ্র মৌলবাদ জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসবাদ দমনে সচেষ্ট হয়েছেন। শুধু তাই নয়, দু’টি দেশের কাছেই এই বিষয়টি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন যে, তার সরকার এই ধরনের সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে না। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসে জেরবার, ভারতও। ভারতের প্রতিরক্ষা খরচ অনেক কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কিছু দিতেও চেয়েছিল। পারেনি কেননা কেন্দ্রীয় সরকার খুবই দুর্বল। যদি সেখানে কোয়ালিশন সরকার না হতো বা বাংলাদেশের মতো কোয়ালিশন সরকার হতো যেখানে শরিকদের কিছু বলা বা করার সুযোগ নেই তাহলে ভারত সরকার তার প্রদত্ত অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারত। আমেরিকাও বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাস দমন নীতির কারণে খুশি। শুধু তাই নয়, মার্কিন নীতির ক্ষেত্রে একটি মৌল পরিবর্তন আনতে পেরেছেন শেখ হাসিনা তাহলো, মৌলবাদী দলসমূহ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদল।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশের প্রধান শত্রু জামায়াতে ইসলামীকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে উল্লেখ করত। আমার মনে আছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এক মার্কিন কূটনীতিবিদের সঙ্গে আমাদের কয়েকদলের বসার আয়োজন করা হয়েছিল, তখন বোঝা যাচ্ছিল তারা বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন করতে যাচ্ছে। একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, মার্কিন মুখপাত্র বলুক, তারা এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং গণতান্ত্রিক সেক্যুলার শক্তির উত্থানই কামনা করে। তারা রাজি হয়নি। এমন কি জামায়াতকে ফান্ডামেন্টালিস্ট বলতেও রাজি হয়নি। ঐ সময় শাহরিয়ার কবির, বিশেষ করে গত এক দশকে যুদ্ধাপরাধ ও জামায়াত বিষয়ে মার্কিন বিচার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সুধী সমাজে প্রচুর লবিং করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। তাদের বিশ্বাস জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক দল যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর একটা কারণ বোধ হয় এই যে, আমেরিকা ১৯৭১ সালে পাকি ও জামায়াতীদের গণহত্যা সমর্থন করেছিল। অনেক পরে অবস্থার একটু উন্নতি হলোÑবাংলাদেশকে তারা মডারেট ইসলামিক স্টেট হিসেবে স্বীকৃতি দিল। আর জামায়াতকে মডারেট ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক দল হিসেবে। এক মার্কিন কর্মকর্তার কাছে আমেরিকাকে মডারেট ক্রিশ্চায়ন স্টেট বলার পর তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছিলাম। যা হোক, শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে আমেরিকা খুব একটা বাধা দেয়নি। বোঝা যাচ্ছিল, তারা তাদের মনোভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। এ বছর তা সম্পূর্ণ পাল্টিয়েছে। আগে জামায়াতী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত, তাদের পক্ষে রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতিও দিতেন। ‘কিন্তু এ বছরের ৬ মার্চ সর্বশেষ সম্পাদিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিষয়ক ব্যাকগ্রাউন্ড নোট’-এ জামায়াতকে একটি ইসলামী মৌলবাদী (ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্ট) দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাছাড়া সম্প্রতি কয়েক বার জামায়াতের পক্ষ থেকে বর্তমান ঢাকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনার সঙ্গে দলীয় নেতাদের সাক্ষাতের কথা প্রচার করা হলেও জামায়াত কার্যালয়ে যাননি মজেনা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নানা পর্যায়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করলেও জামায়াতের সঙ্গে সাক্ষাতের কোন কর্মসূচী রাখছেন না। [যায় যায় দিন, ৬.৫.২০১১]। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে অন্তত এটুকু পরিবর্তন হয়েছে।
অন্য কারণটি হচ্ছে ভূ-প্রকৃতিগত ও ভূ-রাজনীতি। এক সময় বিশ্বে প্রভাব ছিল ভূমধ্যসাগরের, তারপর এসেছে আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগর। এখন চীন ভারত মিয়ানমারের কারণে বঙ্গোপসাগর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীনকে দমিয়ে রাখতে হলে চীনের বিপরীতে শক্তি সমন্বয় করতে হবে। ভারত এখন বন্ধু, মিয়ানমার বন্ধু হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশও বন্ধু হলে চীনকে খানিকটা সংযত থাকতে হবে। ইতোমধ্যে মানবিক সাহায্যের নামে মার্কিন নৌবহরের ঘোরাফেরা, যৌথ দৌড়াদৌড়ি, প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ চলছে। বাংলাদেশ যদি বিগড়ে যায় তা’হলে ভারত খুব সুবিধায় থাকবে না। চীনও সুযোগ নিতে পারে। আপাতত: এই হচ্ছে অস্পষ্ট রূপরেখা। হিলারিকে মার্কিন স্বার্থ বজায় রাখতে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চীন থেকে ঢাকায় আসতে হয়েছে।
হিলারির আলোচনা করার কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তিনি যাননি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই গেছেন এবং সব কাজকর্ম সেখানে সেরেছেন। ডা. দীপু মনিকে অবশ্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই যেতে হবে। ‘সময়ের অভাবে’ সরকারী নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে কোন নৈশভোজে যোগদান করেননি। তবে, ফান্ডামেন্টালিস্টদের মিত্র বিএনপি নেত্রীর বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন। সময় করে ড. ইউনূস ও জনাব আবেদের সঙ্গে নাস্তা সেরেছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।
তারপরও বলব, মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলেছে। হিলারি বাংলাদেশের অগ্রগতির যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন এবং আন্তরিকভাবেই। অন্যান্য প্রসঙ্গে সাধারণভাবে যে সব কথা বলেন সেগুলোই বলেছেন। গর্জন সিং ওরফে মীর্জা ফখরুল ও জনাব আবেদরা যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের [এনজিওদের সুবিধা হয় যাতে] দাবি তুলে বলছেন এটি হিলারিরই বক্তব্য [স্পষ্টভাবে ড. ইউনূস ও জনাব আবেদ তা বলেননি] আসলে কিন্তু এ সম্পর্কে হিলারি কোন বক্তব্য রাখেননি। ইলিয়াস আলী সম্পর্কেও না বরং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আমিনুলের ব্যাপারে। কারণ, মার্কিন বাণিজ্যের সঙ্গে এটি জড়িত। সরকার ও গার্মেন্টস মালিকরা তা বুঝছেন কিনা সন্দেহ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, হিলারির সফর সরকারের কার্যকলাপের এক ধরনের স্বীকৃতি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার হয় না। তারা নিমিষেই বন্ধুকে শত্রু ও শত্রুকে বন্ধু মনে করতে পারে। পাকিস্তান, ইরাক এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। সুতরাং হিলারি আমাদের কিছু দেবেন এমনি এমনি তা হয়না। আমরা কি দিলে কি পাব সেটি যেন মাথায় রাখি। হিলারি বা ওবামা আসবেন সে আনন্দেই যেন কাপড়-চোপড় খুলে নৃত্য না করি এবং এ প্রক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রীর গর্জন মাঝে মাঝে কাজেও দিতে পারে। বরং হিলারিও বিশ্বব্যাংক যতবার ড. ইউনূস বা দুর্নীতি সম্পর্কে বলবেন ততবার ড. ইউনূস পয়েন্ট হারাবেন।
যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য আমরা সবাই বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিলেও আশা করি শেখ হাসিনা ঝাঁপ দেবেন না। পিতাকে তিনি ভালবাসেন। পিতার কবর এখানে। আল্লাহ তাঁকে অনেক তওফিক দিয়েছেন জানি, যদি চান হয়ত আরও দেবেন কিন্তু দেশের তজল্লি যেন থাকে সে দিকে যেন একটু খেয়াল রাখেন। তজল্লি বাড়াতে হলে খালি তওফিকের ওপর নির্ভরশীল হলে হবে না, আশপাশেও একটু তাকাতে হবে

শনিবার, ৫ মে, ২০১২

একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম ও এক অভিশপ্ত জাতির ইতিবৃত্ত



মুনতাসীর মামুন
আজকালকার ছেলেমেয়েরা বোধহয় লরা ইঙ্গেলস ওয়াইল্ডার নাম জানে না, হয়ত তাদের পিতা-মাতাদের কাছেও নামটি অচেনা। কিন্তু আমাদের জেনারেশনের কাছে নামটি প্রিয়। আমাদের ছেলেবেলায় লরার বিখ্যাত ট্রিলজিটি পড়তে পেরেছিলাম মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সুবাদে। প্রথম খ- ‘খোকাখুকুর গল্প শোন’ অনুবাদ করেছিলেন রফিকুল হক। খুব সম্ভব পরের দু’টি খ- অনুবাদ করেছিলেন জাহানারা ইমাম। নাম ‘ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির’ ও ‘নদীর তীরে ফুলের মেলা।’
পুরো সিরিজটি আমাদের খুব প্রিয় ছিল। জাহানারা ইমাম নামটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় সেই থেকে। এর পর ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। গঠিত হয়েছে লেখক সংগ্রাম শিবির। এসব বিষয়ে যিনি সব সময় নেতৃত্ব দেন সেই হাসান হাফিজুর রহমানই যোগাড়যন্ত্র করতেন। সেই সময় লেখকদের সংগ্রামী মিটিংগুলোতে নিয়মিত আসতেন। একবার মনে আছে, প্রেসক্লাবের উল্টোদিকের ফুটপাথে আমরা সবাই জড়ো হয়েছি। খুব সম্ভব মিছিলের জন্য। হাসান হাফিজুর রহমানকে দেখলাম রিকশায় করে নিয়ে এলেন জাহানারা ইমামকে। সেই প্রথম দেখলাম তাঁকে।
মুক্তিযুদ্ধের পরই আসলে তাঁর সঙ্গে আমাদের এক অচ্ছেদ্য স¤পর্ক গড়ে ওঠে। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র মাধ্যমে। বিচিত্রার তখনকার সহকারী স¤পাদক (পরে স¤পাদক) শাহাদাত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, বর্তমানে ব্যবসায়ী শহীদুল্লাহ খান বাদল, হাবীবুল আলমসব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাঁর শহীদ পুত্র রুমীর সহযোদ্ধা। তাই তাঁরা ছিলেন তাঁর অসম্ভব প্রিয়। আমিও তখন যুক্ত ‘বিচিত্রা’র সঙ্গে। তাই যেতাম। আরও পরে, যাতায়াতটা বেশি হতো।
আমি, শাহরিয়ার বা আরও অনেকেই তখন যেতাম তাঁর বাসায়। তখনই তাঁকে সবাই ‘আম্মা’ ডাকা শুরু করেন। অসম্ভব পছন্দ করতেন তিনি এই ডাক। এই ডাকের মাঝে তিনি যেন রুমীকে খুঁজে পেতেন। বয়সে যাঁরা একটু বড় তাঁরা ডাকতেন ‘খালাম্মা’ বলে। আমার ডাকটা ছিল ভিন্ন। আমি ডাকতাম ‘চাচী’ বলে। এর কারণ কী জানি না। আমার বাবা-চাচার বন্ধুপতœীদের চাচী বলতাম, মিসেস ইমামও ছিলেন তাঁদের সমসাময়িক, হয়ত সে কারণেই আম্মার বদলে ডেকে ফেলেছিলাম চাচী। কিন্তু তিনি তা ভোলেননি। পরে আমার খুব অস্বস্তি লাগত। কারণ, আমার বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে সবাই বলতেন ‘আম্মা’। পরে, আর কোন সম্বোধনই করতাম না। কিন্তু, যখনই উনি ফোন করতেন, প্রথমেই বলতেন, ‘তোমার চাচী বলছি।’ কোন্ চাচী বলছেন বুঝতে দেরি হতো না। আমার বিয়েতে ছোট্ট একটি কাঠের মূর্তি উপহার দিয়েছিলেন, সে প্রায় সাতাশ বছর আগে। ছোট্ট একটি চিরকুটে লেখা ছিল‘মামুন-ফাতেমাকে আশীর্বাদ জানিয়েÑচাচী।’
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই ১৯৭৪ সালে। এই সময় যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। যোগাযোগটা আবার গভীর হয় যখন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। বলতেন, ‘আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করিস (ফোন দিবি এই ধরনের ভুল বাক্য তখনও চালু হয়নি)। রাত ১১টার পরে।’
তা, আমি ফোন করতে ভুলে গেলেও গভীর রাতে মাঝে মাঝে ফোন করতেন। ক্যান্সারের কারণে কথা অ¯পষ্ট। বলতেন, সমন্বয় কমিটির কথা। মাঝে মাঝে যে সেখানে দ্বন্দ্ব হতো না, তা নয়। আওয়ামী লীগ কী করবে? আচ্ছা অমুককে সেই খবরটা পৌঁছে দেয়া যায় কি? বা অমুকের মনোভাব জেনে আসা যায়?
১৯৭২ থেকে নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত তিনি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলেন। অসম্ভব শোকে তিনি তখন পাথর। তাছাড়া ছোট ছেলে জামীও আমেরিকায়। এ সময়ই লেখালেখির দিকে মন দেন। তাঁর হাতিরপুলের বাসায় রুমীর মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নিত্য আসা-যাওয়া ছিল। তাহলেও হাহাকার করতেন রুমীর জন্য। রুমীর বন্ধুদের পেলেই শুনতে চাইতেন কী করেছে রুমী তখন। একদিনের কথা মনে আছে। সন্ধের সময়। আমি আর শাহরিয়ার বসে আছি। এমন সময় বাতি চলে গেল। খানিক পর নিঝুম গলায় আনমনে বলতে লাগলেন, “তুই যেখানে বসে আছিস, রুমীও সেখানে বসেছিল। যুদ্ধের সময় এসেছিল। আমি তাকে চোখের আড়াল হতে দিতাম না। একদিন দেখি, খানিক পর পর সে উঠে যাচ্ছে। বুঝলাম যুদ্ধে থাকার সময় সিগারেটের অভ্যাস করেছে। বললাম, ‘তুই সিগারেট খাস? যদিও সিগারেট খাওয়াটা ভাল না। আচ্ছা যদি খেতে হয়, আমার সামনেই খাস। লজ্জার কিছু নেই।’ কেন তাকে বলেছিলাম একথা জানিস। ঐ যে পাঁচ-দশ মিনিট সে আমার সামনে থাকে না, তাও আমার ভাল লাগে না।”
সন্তানের জন্য এই যে তীব্র হাহাকার বাইরে থেকে বোঝা যেত না। কিন্তু কখনও একলা থাকলে তা প্রকাশ পেত।
আরেকদিন বিকেলে। আমি একলাই গিয়েছিলাম কি একটা কাজে। দোতলায় আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখালেন কোথায় রুমী থাকত। রুমীর একটা বড় তেলচিত্র করে এনে টাঙিয়ে রেখেছিলেন।
ঐ সময় শাহরিয়ার আর আমি তাঁকে প্রস্তাব দিলাম আত্মজীবনী লেখার। একটু একটু করে লেখা শুরু করলেন। শৈশব থেকে যৌবনের প্রারম্ভ পর্যন্ত। নাম দিলেন ‘অন্যজীবন’।
আমি আর শাহরিয়ার ‘ডানা প্রকাশনী’ থেকে তা ছাপার বন্দোবস্ত করেছিলাম। কথা ছিল, তার পরের পর্বও লিখবেন। কিন্তু আর লেখা হয়ে ওঠেনি। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের কথা মনে পড়ে। বইটি প্রকাশের ভার নিয়েছিল সন্ধানী প্রকাশনী। বই প্রকাশের আগ মুহূর্তে তিনি মহাউত্তেজিত। ঠাট্টা করে বললাম, ‘আমরা লাইন দিয়ে বই কিনব।’ যেদিন বই প্রকাশিত হলো সেদিনই গেলাম বইটি কিনতে। সঙ্গে আরও কয়েকজন। বইটি কিনলাম এবং তাঁর সামনে তুলে দিলাম। হেসে তিনি লিখলেন, ‘পরম স্নেহাস্পদ মুনতাসীর মামুনকে, জাহানারা ইমাম, ১৭-০২-৮৬’।

॥ দুই ॥

পরম যতেœ, আমাদের গাজী ভাই ১৯৮৬ সালের বইমেলায় প্রকাশ করলেন, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। প্রকাশের পরদিন থেকে আজ পর্যন্ত তার অজস্র সংস্করণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্যে অবশ্য পাঠ্য এই বই। মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্যে ধ্রুপদী গ্রন্থের আসন অর্জন করেছে এই রোজনামচা।
১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনকার রোজনামচার সংকলন ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এই বইয়ে লেখকের কোন ‘ভূমিকা’ বা ‘নিবেদন’ নেই। তবে আছে উৎসর্গপত্র । বইটি উৎসর্গ করেছেন তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলার উদ্দেশে’। বইটির চমৎকার প্রচ্ছদটি এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী।
বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে কেমন আবেগ সৃষ্টি করেছিল ১৯৭১? তারপর অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কীভাবে কাটিয়েছে শত শত পরিবার? জাহানারা ইমাম সেই অবরুদ্ধ প্রতিটি দিনের বর্ণনা রেখেছেন তাঁর বইয়ে। এ রকম অবরুদ্ধ জীবন তো ছিল আমাদের অনেকেরই। একদিক থেকে দেখতে গেলে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস। এই মানুষগুলোর দুঃখ-বেদনা আর সংগ্রাম-সাহসের অনবদ্য দলিল। ঠিক এ রকম আরেকটি দলিল জাহানারা ইমামের বান্ধবী বাসন্তী গুহঠাকুরতার (যিনি ছিলেন বয়সে তাঁর থেকে বড়) যিনি হারিয়েছিলেন স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে। জাহানারা ইমাম হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী শফি ইমাম আর ছেলে রুমীকে।
জাহানারা ইমামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সরদার ফজলুল করিম, কিভাবে তিনি লিখেছিলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’। উত্তর দিতে গিয়ে তিনি কেঁদেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “এটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিজের খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখা। দিনাদিনের ঘটনা। কিন্তু একাত্তরের ঢাকায় বসে এসব লেখার বিপদ আমি জানতাম। তবু অভ্যাস ছাড়তে পারিনি। কেবল নিজের বুদ্ধিতে আজেবাজে খাতার পাতায়, একোণা-ওকোণা করে, আঁকা-বাঁকা লাইনে, কখনও কালো কালিতে, কখনও রঙিন কালি দিয়ে প্রায় ছবির মতো করে দিনের ঘটনাকে ইঙ্গিতে লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। রুমীর নাম উল্লেখ করতে হলে উল্টে লিখেছি ‘মীরু’। মুক্তিযোদ্ধাদের যদি পাঁচ শ’ টাকা পাঠিয়েছি তো লিখেছি, পাঁচখানা কাপড় লন্ড্রিতে দেয়া হয়েছে। বুদ্ধিতে যেমন কুলিয়েছে তেমন করে লিখে রেখেছি। ভেবেছি, যদি হামলা হয়, যদি এ কাগজ হানাদারদের হাতে পড়ে, তবে এরা একে পাগলের আঁকাবুঁকি ছাড়া আর কিছুই ভাববে না।”
১৯৭২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত এই রোজনামচা পড়তেন। যখনই পড়তেন, ‘তখনই কেবল কান্নায় ভেঙে পড়েছি।’ পরে বিচিত্রা স¤পাদক শাহাদাত চৌধুরীর ‘দাবি’তেই লিখলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’।
তখনকার এলিফ্যান্ট রোড খুব নিরিবিলি। ‘কনিকা’ নামের একটি দোতলা বাড়ি গলির শেষ প্রান্তে। সেখানে থাকেন প্রকৌশলী শফি ইমাম, আর তাঁর স্ত্রী জাহানারা ইমাম এবং তাঁদের দুই পুত্র রুমী ও জামী। আমাকে, বিজয়ের পর যখন তাঁর বাসায় যেতাম বলেছিলেন, ‘জানিস রুমীর তো আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা হয়েছিল। ভার্সিটির যে ডরমেটরিতে থাকবে সে ডরমেটরির রুম নম্বরও তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।’ কিন্তু চলে এলো যে ১৯৭১।
আপনাদের মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চের কথা। রুমী সারা শহর ঘুরে এসে জানাচ্ছে তাঁর মাকে, ‘কি যে খই ফুটছে সারা শহরে!’
৭ মার্চ আমরা ভেবেছিলাম, আজ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। দেননি। রুমীও ছিল রেসকোর্সে। আমরা যেমন, রেসকোর্স থেকে ফিরতে ফিরতে এবং বাসায় ফিরেও তর্ক-বিতর্ক করেছি। রুমীও ফিরে বলেছিল, “ আমি কোন দলভুক্ত নই, কোন রাজনৈতিক দলের সেøাগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু, আমি সাধারণ বুদ্ধিস¤পন্ন , মান-অপমান জ্ঞানস¤পন্ন একজন সচেতন মানুষ। আমার মনে হচ্ছে শেখ আজ অনায়াসে ঢাকা দখল করার মস্ত সুযোগ হারালেন।”
রুমী তো আমাদেরই বয়সী। আমরাও অনেকে ওরকম ভেবেছিলাম। কিন্তু ঐ ভাবনা যে ভুল ছিল তা তো পরে প্রমাণিতই হয়েছে।
৭ মার্চ এগোয় ২৫ মার্চের দিকে। বাংলাদেশও এগোতে থাকে স্বাধীনতার দিকে। ২৫ মার্চ রাতে, রুমী বলছে, ‘ওরা শুধু সময় নিচ্ছে। ওরা আলোচনার নাম করে আমাদের ভুলিয়ে রাখছে। শেখ বড্ডো দেরী করে ফেলছেন। এ পথে, এভাবে আমরা বাঁচতে পারব না।’ তাই হলো শেষে।
গণহত্যার সেই দিনগুলোর কথা নতুন করে বলার নেই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একমাত্র ভরসা। বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য যারা পারছে তারাই চলে যাচ্ছে। বাবা-মারাও বাধা দিতে পারছেন না। ৩ মে জাহানারা ইমামের জন্মদিনে এসে জানাল ‘তোমার জন্মদিনে একটি সুখবর দিই আম্মা।’ সে একটু থামল, আমি আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম, ‘ আমার যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে। ঠিকমতো যোগাযোগ হয়েছে। তুমি যদি প্রথমদিকে অত বাধা না দিতে, তাহলে একমাস আগে চলে যেতে পারতাম।’
আমি বললাম, ‘তুই আমার ওপর রাগ করিসনে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তুই হুজুগে পড়ে যেতে চাচ্ছিস, না, সত্যি সত্যি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যেতে চাচ্ছিস।’
‘হুজুগে পড়ে?’ রুমীর ভুরু কুঁচকে গেল, ‘বাঁচা-মরার লড়াই, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে যেতে চাওয়া হুজুগ?’
‘না, না, তা বলিনি। ভুল বুঝিসনে। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে বলেই যেতে চাচ্ছিস কিনা, যুদ্ধক্ষেত্রের কষ্ট ও ভয়াবহ অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করতে পেরেছিস কিনাসে সব যাচাই করবার জন্যই তোকে নানাভাবে বাধা দিচ্ছিলাম। তুই-ই তো বলেছিস, তোর কোন কোন বন্ধু যুদ্ধের কষ্ট সইতে না পেরে পালিয়ে এসেছে।’
‘তা এসেছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। কোটিতে দুইজনার বেশি হবে না।’
‘কবে যাবি? কাদের সঙ্গে?’
‘তিন-চার দিনের মধ্যেই। কাদের সঙ্গেনাম জানতে চেওনা, বলা নিষেধ।’
লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন পাঁজরের সব হাড় চেপে ধরেছে। নিñিদ্র অন্ধকারে, চোখের বাইরে, নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দিতে হবে। জানতে চাওয়াও চলবে না কোন্ পথে যাবে, কাদের সঙ্গে যাবে। রুমী এখন তার নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তার একান্ত নিজস্ব ভুবন, সেখানে তার জন্মদাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই।
‘খলিল জীবরানের প্রফেট’ থেকে এরপর একটি কবিতার দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন যার শেষ তিনটি লাইন
‘তাদেরকে চেয়ো না তোমাদের মতো করতে
কারণ তাদের জীবন কখনোই ফিরবে না
পেছনের পানে।’

॥ তিন ॥
৯ আগস্ট জাহানারা ইমামের ২৪তম বিবাহবার্ষিকী। ৮ আগস্ট রুমীরা এলো ঢাকায়। ছোট ছোট দলে। বলা হতো তাদের ‘বিচ্ছু’। রুমী এসে খবর পাঠিয়েছিল ৮ আগস্ট বিকেলে তাঁকে যেন ‘এক জায়গা’ থেকে নিয়ে আসা হয়। রুমীর বাবা তাকে নিয়ে এলেন।
‘গাড়ির শব্দ পেলাম। গাড়ি এসে পোর্চে থামল। নিঃশব্দে দরজাটা খুলে দিয়েই দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় বেডরুমে চলে গেলাম।
রুমী এসে ঢুকল ঘরে। রুমীর মুখভর্তি দাড়ি, চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, তামাটে গায়ের রঙ, রোদে পুড়ে কালচে, দুই চোখে উজ্জ্বল ঝকঝকে দৃষ্টি, গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে ফুটে রয়েছে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। রুমী দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো, ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। রুমী ফিসফিস করে বলল, ‘আম্মা, আম্মা, থামো। দাদা শুনতে পাবে। তোমার কান্না শুনলে ঠিক সন্দেহ করবে।’ দরজার পর্দা পেরিয়েই সিঁড়ির সামনের চারকোণা মাঝারি ‘হল’ সেখানে ইজিচেয়ারে বাবা শুয়ে থাকেন। শরীফ আর জামী একদৃষ্টিতে রুমীর দিকে চেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। রুমী একবার আমার, আরেকবার শরীফের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলে? কেমন তোমাদের বিবাহবার্ষিকীর আগের দিনটাতে এসে গেলাম!’
একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘সোজা বাড়িতে এলি না কেন?’ আবেগের উচ্ছ্বাস কমতেই কল্পনার চোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখের বিজয়িনীর হাসি, সে সঙ্গে না-বলা উচ্চকিত বাণী ‘কেমন, এবার হলো তো? আমাকে বলা হয়নি। এখন তো সব ফাঁস হয়ে গেল।’
রুমী বলল, ‘কি জানি, ভয় পেলাম রিস্ক নিতে। যদি গলির মোড়ে কোন মিলিটারির সামনে পড়ে যাই, যদি সন্দেহ করে?’
সারা রাত তারা গল্প করল। রুমী মাঝে মাঝে বাসায় থাকত। মাঝে মাঝে চলে যেত বিচ্ছুদের সঙ্গে। মা জানতে চাইতেন নিছক কৌতূহলে। রুমী বলত না। লিখেছেন ‘তবুও কথা বললাম না। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। রুমী যতটুকু বলার, ঠিক ততটুকুই বলবে। তার বেশি একটুও না। আমার জিজ্ঞেস করা বৃথা।
রুমী খানিকক্ষণ আপনমনে শিস দিল, তারপর মৃদুস্বরে আবৃত্তি করতে লাগল :
দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং, ঢোলা
পাজামা, কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতোই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?

দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলজি তোমার আঁতিপাঁতি! তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতি ঘর।
আমি উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কবিতা এটা?’
‘ঢাকার এক বিখ্যাত কবির। নামটা ভুলে গেছি। শাহাদাত ভাই আর আলম মাঝে মাঝে ওর কাছ থেকে নিয়ে যায় ওপারে। মেলাঘরে আমরা কবিতাগুলো পড়ি। ভাল লাগলে দু-একটা কপি করে রাখি তারপর ওগুলো কলকাতায় কার কাছে যেন পাঠিয়ে দেয়া হয়। (চলবে)





(পূর্ব প্রকাশের পর)
‘এটা তো তোদের নিয়েই লেখা বলে মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, এটার নাম ‘গেরিলা’-বাকিটা শোন :
পারলে নীলিমা চিরে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যত যাচ্ছো হাত ধরে পর¯পর।’
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে বললাম, ‘ঐ শাহাদাত আর আলম আর আসে না ঢাকায়?’
‘আসে, আবার চলে যায়।’
‘এবার আসেনি?’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে আবার বললাম, ‘মানে এরপর এলে কবির নামটা জিজ্ঞেস করে নিস।’
রুমী হেসে ফেলল, ‘আম্মা ইউ আর সি¤পলি ইনকরিজিবল। ঐ কবি ঢাকাতেই বাস করছেন। আমি যে নামটা ভুলে গেছি সেটা ও’র জন্য মঙ্গল। তুমি আবার জানতে চাও কেন ? এতে তোমারও বিপদ, কবিরও বিপদ।’
এই এক লুকোচুরি খেলা চলছে। রুমী বলছে, সব কথা জানতে চেয়ো না, ধরা পড়লে টর্চারে বলে ফেলতে পার। আমি কখনও লক্ষ্মী মেয়ের মতো, কখনও অভিমানে, রুমীর কথা মেনে নিয়েও খানিক পরে আবার ভুলে গিয়ে প্রশ্ন করে ফেলেছি।
এবার আর রাগ করলাম না। হেসে বললাম ‘সত্যি, কি জ্বালা। খালি ভুলে যাই। বুড়ো বয়সে সব উলটপুরাণ হয়ে গেছে। এখন তুই বাবা হয়েছিস, আমি তোর ছোট মেয়ে। তাই খুব মনের সুখে বকে নিচ্ছিস।’
ঐ কবি শামসুর রাহমান। তিনি তখন লিখছেন ‘বন্দী শিবির থেকে’র কবিতাগুলো। শাহাদাত ভাই বা অন্য কেউ সেগুলো লুকিয়ে নিয়ে যায় সীমান্তের ওপারে। ছাপাও হয়েছিল বোধহয় তখন কিছু কবিতা। শাহাদাত ভাইয়ের থেকেই রুমীরা প্রথমে পেত সেই কবিতার খবর। রুমীরা মাঝে মাঝে ঢাকায় অপারেশন করে। আমরা যারা অবরুদ্ধ ঢাকার বাসিন্দা তারা উজ্জীবিত হয়ে উঠি। মনোবল বেড়ে যায়, না, স্বাধীন আমরা হবোই। ২৮ আগস্ট একটা সফল অপারেশন শেষ করে রুমী এসেছে বাসায় মার কাছে। লিখেছেন জাহানারা ইমাম ‘আলমরা কথামত রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যায়নি বলে হ্যারিসরা প্রথমে রাগ করেছিল, কিন্তু পরদিন দুপুরে যখন জানতে পারে যে কিরকম সাক্ষাৎ মৃত্যুর ছোবল থেকে ওরা বেঁচে বেরিয়ে এসেছে, তখন আর রাগ থাকে না। এরকম দুঃসাহসিক এ্যাকশনের জন্য সবাই আলমদের ধন্য ধন্য করতে থাকে।
হ্যারিস বলল, ‘চাচী, রুমী তো হিরো হয়ে গেছে। ও যেভাবে গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে গুলি করেছে, সেরকম কাহিনী আমরা এতদিন কমিক বইতে পড়েছি, বিদেশী সিনেমায় দেখেছি। আমারই বন্ধু এরকম একটা কাজ করেছে ভেবে আমারও খুব গর্ব হচ্ছে।’
চেয়ে দেখলাম, রুমীর মুখ গর্বে, লজ্জায়, খুশীতে লাল হয়ে উঠেছে। ক’দিন থেকে বন্ধুদের মুখে ও এসব কথাই শুনছে। আমি বললাম, ‘এরকম কোন একটা এ্যাকশনে কোন একজনকে কিন্তু হিরো বলা যায় না। আসল হিরো হচ্ছে পুরো টিমটাই। প্রত্যেকটি সদস্যের নির্ভুল রিফ্লেক্স আর পারফেক্ট সেন্স অব টাইমিং থাকলে যে নিখুঁত টিমওয়ার্ক হয় তার ফলেই এ্যাকশনের সাফল্য আসে।’
রুমী মাকে রাতে টম জোন্সর সেই বিখ্যাত গানটার কথা বলল। ঐ গান যখন আমরা শুনেছিলাম। আমরাও উদ্বেলিত হয়েছিলাম। একদম ভাসিয়ে নিয়ে যেত, যদিও তা ইংরেজিতে। রুমীর আম্মা লিখেছিলেন ‘আম্মা, গানটা শোন মন দিয়ে’ টম জোনসর ‘গ্রীন গ্রীন গ্রাস’ গানটা বেজে উঠল। বহুবার শোনা এ গান। রুমী এটা প্রায়ই বাজায়। শুনতে শুনতে সুরটা আমারও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, যদিও ইংরেজি গানের কথা বিশেষ বুঝি না। তিন মিনিটের গানটা শেষ হলে রুমী আস্তে আস্তে বলল, ‘গানটার কথাগুলো শুনবে? এক ফাঁসির আসামী তার সেলের ভেতর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে। সে ট্রেন থেকে নেমেই দেখে তার বাবা-মা আর প্রেয়সী মেরি তাকে নিতে এসেছে। সে দেখল তার আজন্মের পুরনো বাড়ি সেই একই রকম রয়ে গেছে। তার চারপাশ দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে সবুজ সবুজ ঘাস। তার এত ভাল লাগল তার মা-বাবাকে দেখে, তার প্রেয়সী মেরিকে দেখে। তার ভাল লাগল তার গ্রামের সবুজ সবুজ ঘাসে হাত রাখতে। তারপর হঠাৎ সে চমকে দেখে সে ধূসর পাথরের তৈরি চার দেয়ালের ভেতরে শুয়ে আছে। সে বুঝতে পারে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল আমি বলে উঠলাম, ‘চুপ কর রুমী, চুপ কর’। আমার চোখে পানি টলমল করে এলো। হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে বললাম, ‘রুমী। রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।’
রুমী মুখ তুলে কি একরকম যেন হাসি হাসল, মনে হলো অনেক বেদনা সেই হাসিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বিন্দুতে সিন্ধু’ দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা? হয়ত জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানিনি, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা-বিষ-সব কিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই, কোন আক্ষেপ নিয়ে যাব না।
ঐদিনই হানাদার বাহিনী এসে রুমী আর রুমীর আব্বাকে তুলে নিয়ে গেল।

॥ চার ॥

ঐদিন রুমীর অন্য বন্ধুরা ধরা পড়েছিল। তারা আলতাফ মাহমুদের বাসায় মাটির নিচে অস্ত্র রেখেছিল। সে অস্ত্রও উদ্ধার করল হানাদাররা আর হত্যা করল আলতাফ মাহমুদকে। সেপ্টেম্বর ১ তারিখে রুমীর বাবা একা ফিরে আসেন। স্বামীর সম্মুখে ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের ওপর চালানো হয় অসহ্য নির্মম অত্যাচার। শরীফ ফিরেছেন, রুমী ফেরেনি।
২ সেপ্টেম্বর তিনি লিখছেনÑ “শরীফকে কর্নেল বলেছিল রুমী একদিন পরে ফিরবে। কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আমি কি বিশ্বাস করেছিলাম? শরীফের ফিরে আসার খবর পেয়ে পরশু বিকেল থেকে বাসায় আত্মীয় বন্ধুর ঢল নেমেছে। সবাই রুমীর জন্য হায় হায় করছে। হায় হায় করছে কেন? তবে কি রুমী ছাড়া পাবার কোন আশা নেই?”
আশা নেই জানতেন। তবুও আশা ছিল। বাংলাদেশের প্রতিটি মা’-যার ছেলে যুদ্ধে গেছে, হানাদার বা রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে তারা মনের গহীন গভীরে জানতেন, না, আশা নেই। তবুও পুত্র ফিরে পাবার আশা ফুরাত না। সবাই তখন অলৌকিকে বিশ্বাস করতেন। জাহানারা তার ব্যতিক্রম নন। তিনিও যেতেন। ১৩ সেপ্টেম্বর ‘রুমীর কোন খবর নেই। প্রতিদিন পাগলা বাবার কাছে যাচ্ছি। তাঁর পায়ের ওপর পড়ে কান্নাকাটি করছি।’ বিভিন্ন সূত্র ধরে হানাদার কর্তাদের কাছেও খোঁজ-খবর হচ্ছে। কোন খবর নেই। দু’মাস পেরিয়ে গেছে। রুটিন কাজ করেন, মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর নেন। কিন্তু ‘সকলেরই মনের অবস্থা খুব খারাপ। দুঃখ, হতাশা, ভয়, ভীতি, নিষ্ফল ক্রোধসব মিলে আমাদেরকে যেন পাগল বানিয়ে ছাড়বে। শরীফের ওজন খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। আমারও কমেছেতবে আমাকে নিয়ে নাকি ভয় নেই। আমি কাঁদি, হাহুতাশ করি, কথা বলি, মনের বা®প বের করে দেই। শরীফ এমনিতেই কথা কম বলে, এখন আরও কমতার ওপর সে কাঁদেও না, হাহুতাশ করে না, মনের বা®প বের করার কোন প্রক্রিয়া তার ভেতর দেখি না। প্রতিদিনের অভ্যস্ত নিপুণতায় সে তার সব কাজ করে যায়সকালে উঠে শেভ , গোসল, ফাঁকে ফাঁকে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনা, তারপর অফিস, বিকেলে টেনিস, সন্ধ্যায় আবার স্বাধীন বাংলা বেতার, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ স¤পর্কীয় আলোচনা ওকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই দুঃখ ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে।’
আর মায়ের যন্ত্রণা। মুখে কিছু বলেন না, সারাদিন ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেন কিন্তু সব সময় মনে হয়, এখনই কড়া নেড়ে উঠবে। ‘কে?’ জানতে চাইলে বাইরে থেকে নিচু গলায় চেনাস্বরে বলে উঠবে রুমী। ‘আস্তে আম্মা দরজাটা খোল।’ কিন্তু কেউ কড়া নাড়ে না। তাই একদিন রুমীর এনলার্জ করা ফটোটা দোকান থেকে এনেছি। বেশি বড় করিনি মাত্র আট বাই দশ। ঐ মাপের একটা ফটোস্ট্যান্ডও কিনে এনেছি। ফটোটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। কতদিন দেখিনি ওই প্রিয়মুখ। এই কি ছিল বিধিলিপি? রুমী। রুমী। তুমি কি কেবলি ছবি হয়ে রইবে আমার জীবনে? তুমি গেরিলা হতে চেয়েছিলে, গেরিলা হয়েছিলে। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দ, ক্ষিপ্র পদসঞ্চারে আঘাত হানতে শত্রুকে, নির্ভুল লক্ষ্যে। শত্রুও একদিন নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনে, রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেল তোমাকে। আর কি ফিরে পাব না তোমাকে? তুমি যে সব সময় জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় বলতে: আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয় তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়/ হয়তোবা হাঁস হবোকিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়/ সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে/ আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে/ জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়/
রুমী, তোমাকে আসতেই হবে আবার ফিরে।
চোখ মুছে ছবিটার নিচে এক টুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে লিখলাম: আবার আসিব ফিরেএই বাঙলায়। ফটোটা রাখলাম নিচতলায় বসার ঘরের কোনার টেবিলে। আগামীকাল ঈদ। অনেক মানুষ আসবে ঈদে মিলতে। তারা সবাই এসে দেখবে-রুমী কেমন কোমরে হাত দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সদর্পে ঘোষণা করছেআবার আসিব ফিরেএই বাঙলায়।’
এই ছবিটার একটা তৈলচিত্র করানো হয়েছিল যা দোতলায় সিঁড়ির মুখে দেয়ালে টাঙান ছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই ছবিটা আগে চোখে পড়ত। আর তিনি কথাবার্তাও বলতেন ঐ ল্যান্ডিংয়ে বসে। যেন, রুমী সব সময় আছে তাঁর সঙ্গে। (চলবে)


একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম ও এক অভিশপ্ত জাতির ইতিবৃত্ত
মুনতাসীর মামুন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
॥ পাঁচ ॥
ঈদ এলো ২০ নভেম্বর। কী করেছিলাম ঈদে। কোন স্মৃতি নেই। হয়ত জামাতে নামাজ পড়ে ফিরে এসেছি। সবাইর জন্য ছিল নিরানন্দ ঈদ। জাহানারা ইমামের বাসায়ও। লিখেছেন ‘আজ ঈদ। ঈদের কোন আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামা-কাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি।
কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপি চুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াব। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’
এর মধ্যে ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো। ১৩ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন শরীফ, রুমীর বাবা। অনেক কষ্টে হাসপাতালে নেয়া হলো। এখান সেখান করে ছোট একটা ঘরে আনা হলো। “একটিমাত্র বেড, বেডের পাশে একটা মেশিন। দু’পাশে এত কম জায়গা দু’তিনজন লোক কোনমতে দাঁড়াতে পারে। এখানে এসে একটা মোমবাতি জ্বালালাম। শরীফকে বেডে তোলা হলো। আমি ফোনের খোঁজে দরজা দিয়ে বারান্দায় এসে নিñিদ্র অন্ধকার দেখে হতাশ হয়ে আবার ঘরের ভেতর ঢুকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলাম। পিজির কর্তব্যরত ডাক্তার দু’জন শরীফের বেডের দু’পাশে দাঁড়িয়ে হাতে করে কার্ডিয়াক ম্যাসেজ দিচ্ছেন। আমি এ.কে খানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেশিনটা? মেশিনটা লাগাচ্ছেন না কেন?’
শরীফের বুকে হাতের চাপ দিতে দিতে একজন ডাক্তার বললেন, ‘লাগাব কী করে? হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ। ব্ল্যাক আউট যে।’
‘হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ করে ব্ল্যাক আউট? এমন কথা তো জন্মে শুনিনি। তাহলে মরণাপন্ন রোগীদের কী উপায় হবে? লাইফ সেভিং মেশিন চালানো যাবে না?’
ঐদিন রাতে আলবদররা ঢাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করছে রায়ের বাজার, মিরপুরে। ঐ রাতেই শরীফ ইমাম মারা গেলেন।
রুমী নেই। স্বামীও নেই। তারপর এত নির্লিপ্তভাবে ১৪ ডিসেম্বরের রোজনামচা লেখা যে, চমকে যেতে হয়। ‘শরীফকে বাসায় আনা হয়েছে সকাল দশটার দিকে।’ কিছু বিবরণ, তারপর, ‘বাড়ির পাশের খালি জায়গাটাতে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন লোক দুপুর সাড়ে ১২টায় জানাজায় শামিল হলেন। চার-পাঁচটা গাড়িতে করে জনাকুড়ি লোক গোরস্তানে গেলেন। সানু, খুকু আর মঞ্জু আমার কাছে রইল। বাবা একেবারে নির্বাক হয়ে তাঁর ইজিচেয়ারে পড়ে রয়েছেন।’
এরপর সংসারের নানা কথা, বোমায় আহত হওয়া তার বাসায় আকবরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, রাতে বিমান আক্রমণ, পাশের বাড়িতে আগুন লাগা, নিজের বাড়িতে আগুন লাগলে যাতে প্রতিরোধ করা যায় সেজন্য দড়ি, বালতি যোগাড় করা। অনেক কথা আছে কিন্তু স্বামী শরীফ ইমামের কথা নেই, যাঁর সঙ্গে ঘর করেছেন ২৫ বছর, যাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন, যিনি রুমীর বাবা।
১৯৮৮ সালে সরদার ফজলুল করিম এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন জাহানারা ইমামকে। মনে হয়, আমার মতো, তিনিও এত নির্লিপ্ত বিবরণ পড়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। জাহানারা বলেছিলেন, ’৭১-এর পর আমার শরীর ও মনের তো চরম বিপর্যস্ত অবস্থা চলছিল। আমি কেবল রুমীর পথ চেয়ে থাকি। রুমী ফিরে আসবে। কিন্তু রুমী আর আসে না। আমি ছিলাম সেই একচক্ষু হরিণীর মতো। একচক্ষু হরিণী সমুদ্রের দিকে ওর কানা চোখটা রেখে ডাঙার দিকে রেখেছিল ডান চোখটা। ও ভেবেছিল, বিপদ আসবে ডাঙার দিক থেকে, সমুদ্রের দিক থেকে নয়। ওর কি হয়েছিল, তা আমি জানিনে। কিন্তু আমার বিপদ তো দু’দিক থেকেই এলো। রুমী দুরন্ত। রুমী ভবিষ্যতের দিকে দ্রুতবেগে ছুটে যেতে চায়। ওকে আমি হারাতে পারিসে আশঙ্কা আমার ছিল। তাই উদ্বিগ্ন চোখ রেখেছিলাম কেবল ওর দিকে। রুমীর আব্বা শরীফের দিকে ছিল আমার কানা চোখ আর বিশ্বাস। এদিক থেকে বিপদ আসবে, কল্পনা করিনি। অথচ রুমী আর ওর আব্বাকে হানাদাররা ধরে নিয়ে যাবার পর নির্মম অত্যাচার করে রুমীর আব্বাকে ফেরত দিলেও শরীফের শরীর ভেঙে পড়ল। বিশ্বাস হতে না চাইলেও শরীফ আর আমি তো জানতাম, রুমীর কি হয়েছে। কিন্তু আমার চাইতেও শরীফের বেদনা অনেক বেশি দুঃসহ। এম.পি হোস্টেলে ওর বুক থেকেই তো ছিনিয়ে নিয়েছে রুমীকে জল্লাদের দল। তারপর রুমীকে কীভাবে হত্যা করেছে, তা কল্পনা করা ছাড়া আমাদের আর তা জানার তো কোন উপায় ছিল না। সেই দুঃসহ কল্পনাতেই শরীফের ওপর আঘাত এলো। একদিন মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। তারপর ১৪ ডিসেম্বর হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন এক নিষ্প্রাণ দেহ হয়ে। কানা চোখ হরিণী আমি। আমার বিপদ এলো দু’দিক থেকেই।’

॥ ছয় ॥
বিজয়ী হলো বাঙালি। এলো ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো এই দিনও তার ভঙ্গি নির্লিপ্ত। বিকেলে রুমীর বাবার কুলখানি। বাড়ির বড় ছেলেরও কোন খোঁজ নেই। ঐ বাড়িতে, বিজয় আনন্দের, কিন্তু তা আসে বেদনার রূপ ধরে। কুল শেষ হয়। রুমীর আম্মার মনে হয় যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখব?
আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার জন্য। ... রাতের রান্নার জন্যও চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই নিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্যও ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মসলা এখান থেকেই বের করলাম।’
বিজয়কে কি তিনি একবারও উপভোগ করতে চাননি? চেয়েছেন, এই জয়ের জন্যই তো তিনি এতদিন অপেক্ষা করছিলেন। এই জয় আনার জন্যই তো রুমী হারিয়ে গেল, রুমীর বাবা চলে গেলেন। কিন্তু সেদিনের কোন কথা তিনি লেখেননি রোজনামচায়।
নীলিমা ইব্রাহীমের স্মৃতিকাহিনীতেও বরং এক টুকরো বর্ণনা পাই। ১৬ ডিসেম্বরের দু-চারদিন পরে লিখেছেন তিনি। আবার লিখেছেন তিনি“দিন দুই-চার পর জাহানারা ইমামকে নিয়ে শহীদ মিনারের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম জেনারেল ওসমানী শহীদ মিনারে। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। সামরিক কায়দায় একটা স্যালুট দিলেন। মনে হলো বিগত দশ মাসের সব দুঃখ, জ্বালা, যন্ত্রণা দূরীভূত হয়ে গেল। জাহানারাকে দেখিয়ে বললামজেনারেল, দেশের জন্য এ স্বামী-সন্তান উভয়কেই উৎসর্গ করেছে। সর্বাধিনায়কের দু’টি চোখ অশ্রু টলমল, ব্যথা-বেদনায় অভিভূত। ...’ বরং ১৭ ডিসেম্বরের কথা লিখেছেন বিস্তারিতভাবে। কিন্তু সেখানেও নেই কোন আবেগ। এই তারিখেই রোজনামচা শেষ। তারপর শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। রুমী ও স্বামী ছাড়া জীবন। যে জীবনে আমাদের মতো অনেকেই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। একসময় পুরো দেশ। ১৭ ডিসেম্বরের উদ্ধৃতি তাই একটু বড় হওয়া সত্ত্বেও উদ্ধৃত করলাম।
‘আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো। মঞ্জুর এসেছিলেন, বাড়িতে যাঁরা আছেন, তাঁরাও সবাই ছাদে উঠলেন। ২৫ মার্চ যে ফ্ল্যাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগ পোলটাতেই আজ আবার সেদিনের সেই পতাকাটাই তুললাম।
সবাই কাঁদতে লাগলেন। আমি কাঁদতে পারলাম না। জামীর হাত শক্ত মুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
(চলবে)


একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম ও এক অভিশপ্ত জাতির ইতিবৃত্ত
মুনতাসীর মামুন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
গত তিনদিন থেকে জামীকে নিয়ে বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি। শরীফের মৃত্যুর পর থেকে ও কেমন যেন গুম মেরে গেছে। মাঝে-মাঝেই খেপে ওঠে, চেঁচামেচি করে, ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়, বলে পাঞ্জাবী মারবে, বিহারী মারবে, আব্বুর হত্যার প্রতিশোধ নেবে। ওকে যত বোঝাই এখন আর যুদ্ধ নেই, যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবী মারলে সেটা হতো শত্রুহনন, এখন মারলে সেটা হবে মার্ডারও তত ক্ষেপে ওঠে। কি যে করি। ওর জন্য আমিও কোথাও বেরুতে পারছি না। তাছাড়া এই যে গুষ্ঠি রয়েছে বাড়িতে। গতরাতেই হোসেন সাহেব ও আসলাম সাহেবরা নিজেদের বাড়িতে চলে গেছেন। কিন্তু বাকিরা নড়তে চাইছে না। কি এক দুর্বোধ্য ভয়ে এই ঘরের মেঝে আঁকড়ে বসে আছে!
আত্মীয়-বন্ধু পরিচিতজন কত যে আসছে সকাল থেকে, স্রোতের মতো। তাদের মুখে শুনছি রমনা রেসকোর্সে সারেন্ডারের কথা, দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় আসার কথা, ইন্ডিয়ান আর্মির কথা, লোকজনের বিজয়োল্লাসের কথা। এরই মধ্যে, রক্ত হিম করা একটা কথাও শুনছি। মুনীর স্যার, মোফাজ্জল হায়দার স্যার, ডা. রাব্বি, ডা. আলিম চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার এবং আরো অনেকেরই খোঁজ নেই। গত সাত-আটদিনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কারফিউয়ের মধ্যে এঁদের বাসায় মাইক্রোবাস বা জীপে করে কারা যেন এসে এঁদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে। বিদ্যুত ঝলকের মতো মনে পড়ল গত সাত-আটদিনে যখনতখন কারফিউ দেয়ার কথা। কারফিউয়ের মধ্যে রাস্তা দিয়ে বেসামরিক মাইক্রোবাস ও অন্যান্য গাড়ি চলাচলের কথা। এতক্ষণে সব পরিষ্কার হয়ে উঠল।
বিকেল হতে হতে রায়ের বাজারের বধ্যভূমির খবরও কানে এসে পৌঁছল। বড় অস্থির লাগছে। কী করি? কোথায় যাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। রুমী! রুমী কি বেঁচে আছে? আমি কি করে খবর পাব? কার কাছে খবর পাব? শরীফ এমন সময় চলে গেল? দু’জনে মিলে রুমীর জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাম, রুমীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন একাই আমাকে সব করতে হবে, একাই সব কষ্ট বহন করতে হবে।
ফোন ও ইলেকট্রিকের লাইন এখনও ঠিক হয়নি। কে ঠিক করবে? সারা ঢাকার লোক একইসঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশি রক্তে দাম দিতে হয়েছে যে কান্নার স্রোতে হাসি ডুবে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার পর একটা মোমবাতি জ্বেলে ভূতুড়ে আলোয় জামীকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম। হঠাৎ দরজায় করাঘাত। তার আগে বাসার সামনে জীপ গাড়ি থামবার শব্দ পেয়েছি। উঠে দরজা খুললাম। কাঁধে স্টেনগান ঝোলানো কয়েকটি তরুণ দাঁড়িয়ে। আমি দরজা ছেড়ে দু’পা পিছিয়ে বললাম, ‘এসো বাবারা, এসো।’
ওরা ঘরে ঢুকে প্রথমে নিজেদের পরিচয় দিল। ‘আমি মেজর হায়দার। এ শাহাদাত, এ আলম। ও আনু, এ জিয়া ও ফতে আর এই যে চুন্নু।’
হায়দার আর আনু ছাড়া আর সবাইকে তো আগে দেখেছি।
চুন্নু এতদিন সেন্ট্রাল জেলে ছিল। ওকে জেল থেকে বের করে এনে রুমীর অনুরাগী এই মুক্তিযোদ্ধারা রুমীর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
আমি ওদেরকে হাত ধরে এনে ডিভানে বসালাম। আমি শাহাদাতের হাত থেকে চাইনিজ স্টেনগানটা আমার হাতে তুলে নিলাম। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম। তারপর সেটা জামীর হাতে দিলাম। চুন্নু মাটিতে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসল। আমার দুই হাত টেনে তার চোখ ঢেকে আমার কোলে মাথা গুঁজল। আমি হায়দারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জামী পারিবারিক অসুবিধার কারণে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি। ও একেবারে পাগল হয়ে আছে। ওকে কাজে লাগাও।’
মেজর হায়দার বলল, ‘ঠিক আছে, জামী, এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার বডিগার্ড হলে। এক্ষুণি আমার সঙ্গে আমার অফিসে চল, তোমাকে একটা স্টেন ইস্যু করা হবে। তুমি গাড়ি চালাতে পার?’
জামী সটান এ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে ঘটাং করে এক স্যালুট দিয়ে বলল, ‘পারি।’
‘ঠিক আছে, তুমি আমার গাড়িও চালাবে।’
জামীর পাশেই আলী দাঁড়িয়ে ছিল। জামী বলল, ‘স্যার, আমার বন্ধু আলী’। মেজর হায়দার গম্ভীর মুখে বলল, ‘ইনফ্যাক্ট আমার দু’জন বডিগার্ড দরকারতোমার বন্ধুকেও এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া গেল। কিন্তু ভেবে দেখ, পারবে কিনা। এটা খুব টাফ জব। চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি।’
পাঁচদিন পর জামী এই প্রথমবারের মতো দাঁত বের করে হাসল, ‘ধাটচল্লিশ ঘণ্টার হলেও পরোয়া নেই।”
কী লিখব এই গ্রন্থ স¤পর্কে। মুক্তিযুদ্ধ স¤পর্কে এত নিরাবেগ লেখা লেখা যায়? যায় না। আমরা তো পারিনি। এই কারণেই জাহানারা ইমাম অনন্য অসাধারণ হয়ে ওঠেন। বর্ণনা নিরাবেগ বটে কিন্তু অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিদিনের চিত্র জানতে চাইলে এই একটি বই পড়াই যথেষ্ট। কারণ, আমাদের সবার জীবনই ছিল এরকম। নিত্য বেঁচে থাকার চেষ্টা। চারপাশে হত্যা বা হত্যার হুমকি, ব্যক্তিগত শোক, তারপরও নিত্যদিনের বেঁচে থাকা। এই বই যখন আবার পড়ি তখন মনে হয় আর যেন ১৯৭১ ফিরে না আসে।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ লেখার সময়ই মনে হয় তার মনে ক্ষত উপশম হতে থাকে। এ বই লেখা ছিল তাঁর কাছে ক্যাথারসিসের মতো। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর যখন সাড়া পড়ে গেল তখন তিনি খানিকটা উজ্জীবিত হয়েও উঠেছিলেন। কারণ, তিনি তো লেখক। তারপর আরও লিখেছেন। হয়ত আরও বেশি লিখতে পারতেন যদি না ঘাতকদের বিচারের দাবিতে আবার পুরো বাংলাদেশকে আবেগমথিত করে তুলতেন। সেটি জীবনের তাঁর এক ভিন্ন অধ্যায়। এ জীবনের কথা নিশ্চয় তিনি ১৯৭১ সালের আগে ভাবেননি।
সরদার ফজলুল করিমের মন্তব্য দিয়েই এই অধ্যায় শেষ করি। তিনি লিখেছেন‘একাত্তরের দিনগুলি’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক টেস্টামেন্ট বিশেষ দলিল। কেবল তাই নয়। এ সততায়, সত্যে, আবেদনে, পরিমিতিতে সংযমের অত্যাশ্চর্য প্রকাশে অত্যাবশ্যক গ্রন্থের রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশের হাজার হাজার পাঠকের ঘরে এ গ্রন্থ আজ রক্ষিত। রক্ষিত হওয়ার মতো গ্রন্থ।

॥ সাত ॥
একাত্তরের দিনগুলি লেখার সময়ই বোধহয় ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার কথা মনের অবচেতনে ঘুরতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পর ঘাতক-দালালদের উত্থান তাঁকে অসম্ভব পীড়া দিতো আরও অনেকের মতো। কিন্তু তাঁর কাছে এই পীড়নের মাত্রা ছিল অন্য অনেক পুত্রহারা মায়ের মতোযা অনুভব করা অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। সে কারণে, যখন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এবং পরে সমন্বয় কমিটি হলো তখন তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা আহ্বান জানিয়েছিল এর ভার নেয়ার জন্য। তিনিও সায় দিয়েছিলেন, যদিও আক্রান্ত তখন ক্যান্সারে। সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে আমরা দেখলাম অন্য এক জাহানারা ইমামকে, যাঁরা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের আগে দেখেননি তাঁদের পক্ষে এ রূপান্তর বোঝা সম্ভব নয়। জীবনের ব্রত হিসেবে নিলেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার। একচুলও নড়েননি সেখান থেকে। (চলবে

(শেষাংশ)সমন্বয় কমিটিতে মাঝে মাঝে মতপার্থক্য হতো, বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ নিয়ে। তিনি শুনতেন, সমাধান দিতেন। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘আন্দোলন আমরা শুরু করেছি। কিন্তু, রাজনৈতিক দল ছাড়া তো আর এ আন্দোলনের সমাপ্তি হবে না। এখন সমন্বয় কমিটিতে সংগঠনের সংখ্যা অনেক। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তারা একমত বটে, কিন্তু অন্যান্য প্রশ্নে তো তা নাও হতে পারে।’সে জন্য রাজনীতিবিদদের মতোই তাঁকে এক সময় কাজ করতে হতো। এভাবে সমন্বয় কমিটি সংহত হয়েছে। যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। কে জানত হাসান ইমামের মতো অভিনেতা বা শাহরিয়ার কবিরের মতো সাংবাদিকও এভাবে জানপ্রাণ দিয়ে খেটে একটি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন।এক রাতে ফোন করে বললেন, ‘আচ্ছা আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কী মনে হয়? তারা কি তেমন উৎসাহী নয়?’ ‘আমি কি আওয়ামী লীগার নাকি? ’ বললাম আমি। ‘তবুও শুনিস-টুনিস তো লোকের কাছ থেকে।’আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ‘বললাম আমি, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া এ আন্দোলন সমাপ্তিতে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।’‘সেটা কি আমি বুঝি না। বুঝি। কিন্তু কি করব? এটা কি অস্বীকার করা যায়, যে কোন কারণেই হোক না কেন, অনেকেই আওয়ামী লীগের প্রতি এলার্জিক এবং তারাও মুক্তিযোদ্ধা এবং আমরাও যে সবশ্রেণীর মানুষকে নিয়ে আসতে পেরেছি তার একটি কারণ তো এই যে আমাদের কোন রাজনৈতিক লেভেল নেই।’‘তা ঠিক।’‘সে কারণেই আমাকে সব সামলে চলতে হয়, নানা চাপের মুখে থেকেও। আর তোর কি মনে হয় না, এ আন্দোলনের সুফল পাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক দলগুলো?’তাঁর এই বিচক্ষণতা রাজাকারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে সাহায্য করেছে এবং তিনি ছিলেন বলেই সমন্বয় কমিটি মসৃণভাবে কাজ করে যেতে পেরেছে। তার মানে এই নয় যে, এখন কমিটি মসৃণভাবে কাজ করে যেতে পারবে না। সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। কোন স্থান শূন্যও থাকে না। সমন্বয় কমিটির এখন বড় দায়িত্ব হবে দেশজুড়ে শহীদ জননী যে আশা জাগিয়ে তুলেছেন তা পূরণ করা।গত মার্চের (দ্বিতীয়) গণআদালতের আগে থেকেই তাঁর অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। চিকিৎসা পুরো না করিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, মার্চে গণআদালত করা না গেলেও তা হতো এক ধরনের নৈতিক পরাজয়। তখন রোজার মাস চলছে। রাত এগারোটায় আমাকে ফোন করলেন। বললেন, ‘অসম্ভব যন্ত্রণা রে। প্রায়ই ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমাতে হচ্ছে। কথাও বলতে পারছি না। কাল বিকেলে কি তুই যাবি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে?’পরের দিন বিকেলে স্থাপত্য অনুষদে একটি অনুষ্ঠান ছিল। তাঁর যাওয়ার কথা ছিল সেখানে। যেহেতু জানেন স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট কবি রবিউল হুসাইন আমাদের প্রিয় বন্ধুদের একজন, তাই আমরা থাকব। বললাম, ‘যাবো। নতুন বইও দিয়ে আসব।’‘আসিস, জরুরি কয়েকটি কথা আছে।’পরের দিন ইফতারের সময় দেখা। দেখে মনে হলো না যে ভীষণ যন্ত্রণা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ইফতার করতে করতে কথা শেষ করলেন। বললেন, ‘আমাকে জানাস কিন্তু।’ যে দেশে রাজাকার বইটি দেখে খুশি হলেন। বললেন, ‘যায়যায়দিন কিন্তু আমি নিয়মিত পড়ি। লিখিস কিন্তু সেখানে। আমরা যে যেখানে আছি সেখানে থেকেই যেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারি। নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে পারি, আসলে মুক্তিযুদ্ধ কী ছিল। আর রাজাকার-আলবদররা কী করেছিল। এ দেশে যদি ঘাতকরা পুনর্বাসিত হয় তাহলে তারাও নিরাপদ নয়, যেমন নিরাপদ ছিলাম না আমরা ১৯৭১ সালে।’জীবনকে ভালবাসতেন বলেই তিনি অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা সয়ে শেষ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। আর জীবনকে ভালবাসতেন দেখেই না আমাদের ও নতুন প্রজন্মের জীবনটাকে নিরাপদ রেখে যেতে চেয়েছিলেন।এখন মনে হয়, যদি তিনি গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য চিকিৎসা অস¤পূর্ণ রেখে ফিরে না আসতেন, তাহলে হয়ত আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতেন।কে জানে? কিন্তু, দেশ, মানুষ, কর্তব্য তাঁর কাছে নিজের চেয়েও জরুরি মনে হয়েছে। বাংলাদেশটা এখন এমনই হয়ে গেছে যে, গোলাম আযমরা সদম্ভে বেঁচে থাকে আর জাহানারা ইমামদের চলে যেতে হয়। কি অসম্ভব এক দেশ। একবার খুঁজে খুঁজে ছেলেমেয়েদের জাহানারা ইমামের বই কিনে দিয়েছিলাম। তখন একবার মনে হলো, নিজের ও বন্ধু-বান্ধবদের ছেলেমেয়েদের জন্য তাঁর একটি করে অটোগ্রাফ রাখা জরুরি। অন্তত স্মৃতি হিসেবে। আমি তাঁকে জানাতেই বললেন, ‘চলে আয়। একটু রাত করে আসিস।’ রাত দশটার দিকে গেলাম। তখনও সমন্বয় কমিটির নেতাকর্মীরা ছিলেন। তাঁরা চলে যেতেই, সেই রাত সাড়ে দশটায় ভাল করে খাওয়ালেন। তিনি অসম্ভব ক্লান্ত তখন। ব্যথাও বোধহয় শুরু হয়েছে। বললেন, ‘দে।’ আমি নাহীন-রয়া-নাবীল-দীয়া-দিতি-বিম্বার খাতাগুলি মেলে ধরলাম। এত যন্ত্রণার মধ্যেও অক¤িপত হাতে লিখলেন‘আগামী মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক সৈনিক হও। বাংলাদেশকে অপশক্তির করাল থাবা থেকে মুক্ত কর। নিঃশঙ্কচিত্তে মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে যাও। আশীর্বাদ, আশীর্বাদ। জাহানারা ইমাম। ১৭ বৈশাখ, ১৪০০। ঢাকা।’
আট.যেদিন আমেরিকা থেকে তাঁর মরদেহ আসে সেদিন আমি ও আমার বন্ধুরা গিয়েছিলাম বিমানবন্দরে। জাহানারা ইমাম যেমন কাঁদেননি পুত্র-স্বামীকে হারিয়ে, তাঁর মরদেহ দেখেও আমরা কাঁদিনি। শুধু মনে পড়ছিল, তিনি শহীদ জননী, বাংলাদেশের অগণিত শহীদ জননীর প্রতীক, নিদারুণ শারীরিক কষ্ট আর অশেষ শোক সহ্য করে নীরবে চলে গেলেন। দেশে ফিরে এলেন, নিজে দেশদ্রোহী হিসেবে।গণআদালতের সাফল্যের পর খালেদা জিয়া ২৪ জনের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র মামলা এনেছিলেন। হাইকোর্টের জামিনে তাঁরা মুক্ত ছিলেন। এ এক অসম্ভব দেশ। খুনীদের প্রতীকী বিচারের জন্য দেশদ্রোহিতার মামলা হয়। শেষবারের মতো বিদেশ যাওয়ার আগে যখন দ্বিতীয় গণআদালত হলো (বা গণ তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট যেদিন পাঠ করা হলো) সেদিনও পুলিশ হামলে পড়েছিল। পুলিশের লাঠিতে আহত হয়েছিলেন।তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক সৈনিক হও।’ হতে পেরেছি কিনা জানি না। কিন্তু আমি ও আমার বন্ধুরা সে চেষ্টা করেছি। শেখ হাসিনা হানাদারদের সহযোগী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করেছেন। কয়েক খুনী-ধর্ষকের বিচার শুরু হয়েছে। বলা যেতে পারে, জাহানারা ইমামের স্বপ্ন সফল হয়েছে। এই প্রক্রিয়া হয়ত চলবে শেখ হাসিনা যতদিন থাকবেন ক্ষমতায়, ততদিন। তারপর, যদি খালেদা জিয়া ও জামায়াত ক্ষমতায় আসে তাহলে পরদিনই এই ট্রাইব্যুনাল বাতিল হয়ে যাবে। এসব যখন ভাবি তখন শত সমালোচনা সত্ত্বেও মনে হয়, আওয়ামী লীগের ফের ক্ষমতায় আসাটা বাঞ্ছনীয়।১৯৭১ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়লে তা অনুধাবন করা যায়। ১৯৭৫ জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল। আমরা বলেছি, ১৯৪৮ সাল থেকে যে সংগ্রামের শুরু, তা পরিণতি পেয়েছিল ১৯৭১ সালে। সেটিই আমাদের ইতিহাসের মূলধারা। জিয়াউর রহমান বললেন, না, ইতিহাসের মূল ধারা ১৯৪৭ই১৯৭৫ তার পরিণতি। ১৯৭০-৭১ ছিল বিচ্যুতি। ইতিহাসের এই লড়াইটা এখনও চলছে। বাংলাদেশে যতদিন যুদ্ধাপরাধীরা থাকবে, রাজনীতি করবে, ছড়ি ঘোরাবে ততদিন মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালের মতো আমরা অবরুদ্ধ দেশে আছি। পৃথিবীতে এমন একটা দেশের নাম বলুন, যেখানে স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি বসবাস করছে। কোন দেশ আছে বলুন, যেখানে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ যুদ্ধাপরাধীদের প্রকাশ্যে সমর্থন করছে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না।এই বিজয় দিবসের প্রাক্কালে যখন আবার ‘একাত্তরের দিনগুলি’র কথা পড়ছি তখন বার বার বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছি। চল্লিশ বছর আগে মনে হয়েছিল আমরা বিজয়ী, আমরা শুদ্ধ জাতি হিসেবে গর্ব করতে পারি। আজ ৪০ বছর পর মনে হলো, বিজয়ী হলে দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা থাকে কীভাবে। শুদ্ধ হলে এত বিভক্ত কেন? আমরা আর যে জাতির একাংশ খুনী-ধর্ষক লুটেরাদের প্রকাশ্যে জয়োল্লাসে সমর্থন করে, বিজয়ীদের নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সে জাতি কেন হবে অনুকরণীয়। আমার তাই মনে হয়, আমরা এক অভিশপ্ত জাতি। মানুষের বাচ্চারা এমন আচরণ করে না।